বাংলা ভাষার উৎপত্তি সম্পর্কে নানা মুনির নানা মত রয়েছে। কারও মতে খ্রিস্টীয় নবম-দশক শতকে, কারও মতে,
হাজার থেকে দ্বাদশ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এবং কারও কারও মতে, সপ্তম থেকে অষ্টম খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বাংলা ভাষার উৎপত্তি। ড. শহীদুল্লহর হিসাব অনুযায়ী ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে বাংলা ভাষার আরম্ভকাল। বাংলা ভাষার উৎপত্তি যখনই হোক, চর্যাপদ যে, বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই এবং এর বিপরীতে অন্য কোনো গ্রহণযোগ্য প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত চর্যাপদকেই বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন গণ্য করতে হবে। তাই ‘চর্যাপদ’ অদ্যাবধি বাংলা ভাষার প্রাচীন নিদর্শনের আসনে অধিষ্ঠিত। এখন প্রশ্ন হলো, চর্যাপদ বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন হলে নেপালে গেল কীভাবে? এর উৎস-ভাষা এবং লেখার স্থানই বা কোথায়? বাংলাদেশে বৌদ্ধ ধর্মের আবির্ভাবের প্রারম্ভ হতে চট্টগ্রাম অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও শিক্ষাগত প্রাধান্য ছিল। চর্যাপদের ভাষা, শব্দগঠন, না-বোধক শব্দের অবস্থান, উৎপত্তিগত ইতিহাস, রচয়িতাদের ধর্ম, প্রাকৃতিক পরিবেশ, আধুনিক চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা ও চাটগাঁইয়া ভাষার সাহিত্যকর্ম, আরকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্যচর্চা প্রভৃতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, চট্টগ্রামে চর্যাপদ রচিত হয়েছে এবং চর্যাপদের রচয়িতাগণের অধিকাংশই ছিলেন চট্টগ্রামের অধিবাসী। অধিকন্তু তাঁরা যে দোহা বা চর্যাপদ নামের কাব্য সৃষ্টি করেছেন তা চট্টগ্রামের প্রাচীন আঞ্চলিক ভাষা অনুসরণে রচিত।
১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজকীয় গ্রন্থাগারে হাতে লেখা একটা পুঁথির সন্ধান পেয়েছিলেন। পুঁথিটির নাম ‘আশ্চর্য চর্যাচয়’ বা ‘চর্যাচর্য বিনিশ্চয়’। ‘চর্যাচর্য বিনিশ্চয়’ সাধারণ্যে ‘চর্যাপদ’ নামে পরিচিত। ‘চর্যাপদ’-এর কবিতাগুলো বৌদ্ধ বাউল বা বৌদ্ধ লোকধর্মের অনুসারী। রচয়িতাগণ চর্যাসমূহে বিভিন্ন উপমায় ধর্মীয় বিষয়াদি ব্যাখ্যা করেছেন। অধিকন্তু চর্যাপদে বাংলাদেশের নদ-নদী, পাহাড়, খাল, বিল আর সাধারণ মানুষের কথা, সমাজের সুখ-দুঃখ ও দারিদ্র্যের কথা বিশেষ ভঙ্গিমায় ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস লক্ষণীয়। সবচেয়ে বড়ো কথা হচ্ছে, চর্যাপদের ভাষা আধুনিক বাংলা ভাষার চেয়ে, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গে সমধিক সাযুয্যপূর্ণ।
চট্টগ্রামের বৌদ্ধ ইতিহাস সুপ্রাচীন। সুস্পা কাহ্নপো রচিত ‘পাগসাম-জোন-জন’ ও লামা তারানাথ লিখিত ‘কাবাভদুন দন’ নামের তিববতীয় গ্রন্থে চট্টগ্রামে বৌদ্ধ প্রাধান্য ও তাদের ধর্মমুখী সাহিত্যচর্চার কথা উল্লেখ আছে। ওই গ্রন্থদ্বয় থেকে জানা যায়, চট্টগ্রামের প্রাচীন নাম ‘জালনধারা, যার অপভ্রংশ ‘জলন্দর’, কোথাও কোথাও জুলধা। এই জুলধার কেন্দ্র ছিল বর্তমান কর্ণফুলী নদীর তীরে অবস্থিত কর্ণফুলী উপজেলায়। ওই উপজেলায় এখনও জুলধা নামের একটি গ্রাম রয়েছে। সিন্ধু দেশীয় বৌদ্ধ সিন্ধু বালপাদ চট্টগ্রাম অঞ্চলে কয়েক বছর সাহিত্য সাধনা করেছিলেন বলে জালন্ধরী পাদ বা জুলধা পাদ নামে খ্যাত হয়েছিলেন। তার অপর নাম হাড়িফা। তিনি ঝাড়ুদার হাঁড়ির কাজ করেছিলেন বলে এই নামেও পরিচিত ছিলেন। প্রাচীনকাল হতে সমুদ্রপথে নিরাপদ যাতায়াতোপযোগিতার কারণে ভারতীয় উপমহাদেশ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থল ছিল চট্টগ্রাম। তিনি চট্টগ্রামে এসে বর্তমান চরপাথরঘাটা এলাকায় উঠেছিলেন। জলে যাতায়াত প্রাধান্যের কারণে চট্টগ্রাম জলন্দর নামে অভিহিত হতো। তখনকার চট্টগ্রাম বর্তমান বাংলাদেশের অংশ ছিল না। তখন চট্টগ্রাম ছিল আরকানের অধীন, যে আরকানে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় প্রাচীনকাল হতে বাংলা সাহিত্যচর্চা চলত। নবম শতকের শেষদিকে চট্টগ্রাম পাট্টিকারার চন্দ্রবংশের রাজাদের শাসনাধীনে ছিল এবং পাট্টিকারার চন্দ্র রাজবংশের সাথে আরাকানের চন্দ্রবংশের রাজাদের জ্ঞাতিসম্পর্ক ছিল। অধিকন্তু নেপালের রাজাদের সঙ্গেও ধর্মীয় কারণে সুসম্পর্ক ছিল।
খিস্ট্রীয় আনুমানিক অষ্টম শতকে পূর্ববঙ্গের চট্টগ্রামে পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল। পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয় ছিল উপমহাদেশের একটি প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয় ছিল নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এটি পূর্ববঙ্গে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম বিষয়ের শিক্ষা ও মতবাদ প্রচারের কেন্দ্র হিসেবে পরিচালিত হতো। ত্রয়োদশ শতকে এক সংঘাতে বিহারের নালন্দা বিহার ধ্বংস হয়ে গেলে পূর্ব দেশীয় বৌদ্ধ পন্ডিতবর্গের অনেকে পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। পাল সাম্রাজ্যের বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারক অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান পন্ডিতবিহারে কিছুকাল অবস্থান করেছিলেন।
এখন দেখা যাক, চর্যাপদ কী? তিববত বিশেষজ্ঞ হিসেবে খ্যাত পন্ডিত শরচ্চন্দ্র দাস, লামা তারানাথের তিববতী গ্রন্থ থেকে পন্ডিতবিহার সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। তিনি গ্রন্থ দুটি পর্যালোচনা করে বলেছেন, পূর্ববঙ্গে তথা চট্টগ্রামে মহাযান বা তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মবিষয়ক শিক্ষা ও ধর্মপ্রচারের প্রধান কেন্দ্র ছিল চট্টগ্রাম। মূলত এই কাজ পরিকল্পিতভাবে সুসম্পাদনের জন্য পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকগণ অধ্যাপনা, অধ্যয়ন ও যোগ সাধনার পাশাপাশি অবসর সময়ে যে সব গান-দোঁহা রচনা করেছিলেন তাই পরবর্তীকালে চর্যাপদ নামে বাংলা ভাষা ও বাংলা কাব্যের আদি নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। পন্ডিতবিহারের পূর্বে এবং পরবর্তীকালে আঠারো শতকের মধ্যকাল পর্যন্ত অন্য কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম ইতিহাসে পাওয়া যায় না। অতএব এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, চর্যাপদ চট্টগ্রামে অবস্থিত পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয়ে রচিত হয়েছিল। পন্ডিতবিহারের অবস্থান সম্পর্কে বিভিন্ন মত প্রচলিত রয়েছে। প্রাপ্ত কিছু স্মারক নিদর্শন অনুযায়ী তিব্বত ও বৌদ্ধ সংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ শরচ্চন্দ্র দাসসহ আরও কিছু ইতিহাসবেত্তা ও গবেষকের মতে, অনুমান অষ্টম শতকে চট্টগ্রাম মহানগরের বর্তমান জেনারেল হাসপাতাল সংলগ্ন পাহাড়ে পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল। কারও মতে সীতাকুন্ড উপজেলার চন্দ্রনাথ পাহাড়ে আবার কেউ কেউ মনে করেন, চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার চক্রশালায় অথবা আনোয়ারা উপজেলার দেয়াঙ পাহাড়ের দক্ষিণাংশে ঝিওরী ও হাজিগাঁও গ্রামে পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল। তবে অধিকাংশ যুক্তি-মত, প্রাপ্ত প্রমাণ এবং তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে দেয়াঙ পাহাড়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির অবস্থান ছিল বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। উল্লেখ্য, ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রæয়ারি মাসে আনোয়ারা উপজেলার দেয়াঙ পাহাড়ের নিকটবর্তী ঝিওরী ও হাজিগাঁও গ্রামের সীমান্তে পিতলের ৬৬টি বুদ্ধমূর্তি পাওয়া যায় যা এই স্থানে পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান নিশ্চিত করে। যেখানেই হোক না কেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান যে চট্টগ্রামে ছিল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। বিশেষজ্ঞগণের অভিমত, চট্টগ্রামে অবস্থিত পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদসমূহ রচিত হয়েছিল।
আরাকানের প্রাচীন ইতিহাসসূত্রে জানা যায়, চক্রশালা ছিল আরাকান রাজ্যের আঞ্চলিক সদর দপ্তর। আনোয়ারার দেয়াঙ পাহাড়ে পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পূর্বে অনুমান ২০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে চট্টগ্রামের চক্রশালায় বৌদ্ধ বিহার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এটি ছিল বঙ্গদেশের প্রাচীনতম বিহার। তবে এটি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ছিল না। গৌতমবুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত চক্রশালায় বুদ্ধের জীবিতাবস্থায় একটি বৌদ্ধচক্র নির্মিত হয়েছিল। এই চক্রকে ঘিরে বৌদ্ধ বিহারটি নির্মিত হয়। বৌদ্ধধর্মের প্রচার, ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান এবং অনুসারী সাধারণ লোকদের ধর্মীয় বিধিবিধান সম্পর্কে অবহিত করার জন্য বিহারটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এ বিহারের অন্য একটি উদ্দেশ্য ছিল, আঞ্চলিক ভাষার মাধ্যমে সাধারণ লোকদের সচেতন করা। সংস্কৃতভাষী ব্রাহ্মণদের দৌরাত্ম্য হতে মানুষের মুখের ভাষাকে রক্ষার জন্য গৌতম বুদ্ধই আঞ্চলিক ভাষায় ত্রিপিটক রচনা করে বিশে^ মাতৃভাষা আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন যা তাঁর অনুসারীদের অনুপ্রাণিত করে। ফলে বৌদ্ধপন্ডিতগণ যেখান থেকে চট্টগ্রম বিহারে আসুক না কেন, সাহিত্যচর্চায় চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষাকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন।
যাই হোক, চক্রশালা বিহার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর চক্রশালা পূর্ববঙ্গে সাহিত্যসাধনা ও বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের মিলনকেন্দ্রে পরিণত হয়। সিদ্ধাচার্যগণ এখানে বসে সাধারণ মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত ভাষা তথা প্রাচীন বাংলা ভাষায় বিভিন্ন কবিতা, পদ রচনা করেন। এগুলোই হচ্ছে বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শনের সূচনা। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত অতি অল্প কয়েকটি চর্যাপদ ছাড়া অধিকাংশের হদিস এখনও পাওয়া যায়নি, হয়তো হারিয়ে গেছে। চক্রশালা বিহারে শুধু চর্যা রচিত হতো না, পালি ভাষাতেও নানা শ্লেক রচিত হতো। কিছু কিছু পাদকার পালি ভাষায় এবং কেউ কেউ প্রাচীন বাংলা ভাষায় কবিতা রচনা করতেন। ষষ্ঠদশ শতক থেকে চট্টগ্রামের প্রাচীন আঞ্চলিক ভাষায় বাংলায় কবিতা লেখার প্রচলন বেড়ে যায়। মুদ্রণ যন্ত্র না থাকায় প্রকাশিত পুস্তকাদি হাতে লেখা হতো এবং অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা কারণে এর প্রচার নির্দিষ্ট অঞ্চলে সীমাবদ্ধ থেকে যেত। তাই আঞ্চলিক ভাষায় সাহিত্যকর্ম করলে তা সহজে জনমনে আলোড়ন তুলতে সক্ষম হতো। এ জন্য চর্যাকারগণ মূলত চট্টগ্রামের প্রাচীন আঞ্চলিক ভাষায় সাহিত্য কর্ম করতেন। যার প্রভাব এখনও আরকান, বার্মিজ ভাষা, নেপাল ও ভারতের বিভিন্ন বঙ্গসংলগ্ন রাজ্যে লক্ষণীয়।
চট্টগ্রামে বসে এসব চর্যা বা দোহাগাণ রচিত হয়েছে বলে চর্যাপদের বাক্যের গঠনে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার প্রভাব ব্যাপকভাবে লক্ষ করা যায়। এ প্রসঙ্গে কবি ভূসুকপাদের একটি পদ উল্লেখ করা যায় :
কাহেরে যিনি মেলি আছহ কীস,
বেড়িল পড় অ চৌদীষ।
আপনা মাংস হরিণা বৈরী,
খনহন ছাড় ভূসুক আহেরি।
তিন ন’চ্ছই হরিণা পিবই ন’পানী,
হরিণা হরিণীর নিল অন জানি।
এখানে বর্ণিত আছহ কীস, খনহন ছাড়, ন’চ্ছই ন’পানী, অন জানি প্রভৃতি শব্দগুচ্ছের ব্যবহার কেবল চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা রীতির অনুরূপ। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় না-বোধক শব্দ ক্রিয়ার আগে বসে। যেমন : ন যও, ন চঅ ইত্যাদি। চর্যাচর্য বিনিশ্চয়ের চর্যাসমূহেও ক্রিয়ার আগে না- বোধক পদ ব্যবহৃত হয়েছে। আদি চর্যাকার লুইপা অধিকাংশ চর্যাকারের চর্যায় চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা অনুযায়ী বাক্যগঠন লক্ষণীয়। কুক্কুরীপা, গুন্ডরীপা, ভুসুকুপা, কাহ্নুপা, ডোম্বীপা, শান্তিপা, মহিধরাপাসহ প্রায় সবার চর্যাপদে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার শব্দ বিন্যাস দেখা যায়। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার মতো এখানে ‘না’ শব্দটি ‘ন’ হয়ে ক্রিয়ার আগে বসেছে। বাক্যে শব্দে শব্দে ব্যবহৃত হয়েছে চন্দ্রবিন্দু।
এ প্রসঙ্গে আরও কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যায় : সিট করিঅ মহাসুহ পরিমাণ (লুইপা), ধুলি ধুলি পিটা ধরণ ন জাই (কুক্কুরী পা), জোইণি তঁই বিনু খনহি ন জীবমি (গুন্ডরিপা), খনছ না ছাড়অ ভুসুঅ হেরি, তিন নচ্ছুপাই হরিণা পিবাই ন পাণী (ভুসুকুপা), ভানুই হ্নু মোহিঅহি ন পইসই (কাহ্নপা), ভাবাভাব বলাগ না ছুধ (কাহ্নপা), তান্তি বিকণঅ ডোম্বি অবর ন চঙ্গতা (কাহ্নুপা), করুণা পিহাড়ি খেলছঁ নঅ কল (কৃষ্ণাচার্য পা), আগে নাব ন ভেলা দীসঅ ভাস্তি না পুচ্ছসি নাহা (শান্তিপা), বিদুজণ লোঅ তোঁরে কণ্ঠ ন মেলাঈঁ (কাহ্নুপা) প্রভৃতি।
শুধু এই চর্যাপদ নয়, অধিকাংশ চর্যার বাক্যগঠনে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার গঠনশৈলী, অর্থ ও পরিবেশ-পরিক্রমা লক্ষণীয়। চর্যাচয় বিনিশ্চয় গ্রন্থে ২৩ জন কবির মোট ৫০টি পদ ছিল। কিন্তু হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যে পান্ডুলিপিটি আবিষ্কার করেন সেখানে খন্ডিত ও ছেঁড়া থাকায় সাড়ে ৪৬টি পদ পাওয়া যায়। চর্যাপদ যারা রচনা করেছিলেন তাদের বলা হতো সিদ্ধাচার্য। চর্যাপদের ২৩ জন কবির অধিকাংশের লেখায় চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার শব্দ গঠন রীতি সুস্পষ্ট।
এবার দেখা যাক, বাংলার প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদ কীভাবে নেপাল গেল। পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর চক্রশালা বৌদ্ধবিহারের সমদুয় কাগজপত্র দেয়াঙ পাহাড়ে অবস্থিত পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানান্তর করা হয়। পন্ডিতবিহারের প্রধান অধ্যক্ষ ছিলেন পটিয়া উপজেলার চক্রশালায় জন্মগ্রহণকারী ব্রাহ্মণ সন্তান তিলপাদ। তিনি হিন্দু থেকে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর হিন্দুকালীন যোগসাধন সঙ্গিনী তিল পিষে জীবন ধারণ করতেন। তাই তিনি তিলপাদ নাম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি মহাযান তথা তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করার পর প্রজ্ঞাভদ্র নাম ধারণ করেন। পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয়ের বৌদ্ধ পন্ডিতদের প্রধান কাজ ছিল মহাযান বা তান্ত্রিক বৌদ্ধদের ধর্মীয় বিধি, দোহাগান বা চর্যপদ রচনা, পূজার জন্য দেবদেবীর কম্পনা, মন্ডল আঁকা, স্তব-স্ত্রোত্র, ধারণী মন্ত্র এবং টীকা-টিপ্পনীসহ গ্রন্থাদি রচনা।
পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ প্রজ্ঞাভদ্র, সংস্কৃত, পালি ও চট্টগ্রামের প্রাচীন আঞ্চলিক মিশ্রিত ভাষায় ছয়টি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। গ্রন্থগুলো হচ্ছে, শ্রী সহজ শম্বরস্বাধীষ্টান, অচিন্ত্য মহামুদ্রনাম, তত্ত¡ চতুরোপদেশ প্রসন্নদীপ, যোহা কোষ, ষড় ধর্মোপদেশ এবং মহামন্ত্রোপাদেশ। ইতিহাসবেত্তাদের ধারণা, প্রজ্ঞাভদ্রের জন্মস্থান চট্টগ্রাম হলেও তিনি সারাজীবন চট্টগ্রাম কাটাননি। অনেক ইতিহাসবেত্তা প্রজ্ঞাভভদ্র লিখিত অচিন্ত্য মহামুদ্রনাম গ্রন্থটি বিশ্লেষণ করে বলেছেন, এটি ‘যশঃপালপুরঃ’ নামক স্থানে লিখিত হয়েছিল। স্থানটি চট্টগ্রামে নয় বলে অনেকের অভিমত। কেউ কেউ মনে করেন, স্থানটি নেপালে অবস্থিত। তিনি কোনো বিশেষ কারণে চট্টগ্রাম হতে নেপাল গমন করেছিলেন। অবশ্য এটা ঠিক যে, প্রজ্ঞাভদ্র সারাজীবন পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটাননি। তিনি চট্টগ্রামের পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নেপাল গিয়েছিলেন। নেপাল যাবার সময় পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু গ্রন্থ নিয়ে যান। ওই গ্রন্থসমূহের সঙ্গে চর্যাচর্য বিনিশ্চয় পুথিটিও ছিল যা ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে মহামহোপাধ্যায় হরপপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজকীয় গ্রন্থাগার হতে উদ্ধার করেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর উদ্ধারকারী পুথি ছাড়াও অনুরূপ আরও অনেক পুথি পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল, যা কালের প্রবাহে ও সংরক্ষণের অভাবে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ভাগ্যিস প্রজ্ঞাভদ্র চর্যাচর্য বিনিশ্চয়ের একটা পুথি নেপালে নিয়ে গিয়েছিলেন, বাংলাদেশে থাকলেও ওগুলোও বিলুপ্ত হয়ে যেত।
চট্টগ্রামের লোকগান কত প্রাচীন তা যথার্থভাবে নির্ণয় করা কঠিন হলেও আধুনিক গবেষণায় প্রতীয়মান হয়েছে, চট্টগ্রামের লোকগান চর্যাপদের সমসাময়িক। অনেকের মতে, চর্যাপদের পূর্ব থেকে চট্টগ্রামের লোকগানের উৎপত্তি। পাহাড় নদীর সংগম আর নিজস্ব ভূনের স্বকীয়তা চট্টগ্রামবাসীকে বহুপ্রচীনকাল থেকে লোকগানের প্রতি প্রকৃতিগতভাবে আকৃষ্ট করে রেখেছিল। তাই চট্টগ্রামের লোকগানের ভাষা, অক্ষর ও বিন্যাসের সঙ্গে বাংলার আদি নিদর্শন চর্যাপদের চমৎকার সাযুজ্য ও মিল দেখা যায়।
মধ্যযুগের কবিদের মধ্যে আলাওল, সৈয়দ সুলতান, দৌলত উজির বাহরাম খান, মোহাম্মদ মুকিম, আব্দুল হাকিম প্রমুখ প্রসিদ্ধ কবিদের নাম আমরা পাই। চর্যাপদের সুরের কাছাকাছি সুরের দ্যোতনা দেখা যায় আস্কর আলী পন্ডিতের গানে। তিনি গেয়েছেন : কী জ্বালা দি গেলা মোরে, - - - ন রাখি মাটিতে, ন রাখি পাটিতে ন রাখি পালংকের পরে।’ এমন আরও গান আছে যেমন : ন মাতাই ন বুলাই গেলিরে বন্ধুয়া, মনর আশা ন ফুরালি - - -। এসময়কালের লোকগীতিকার আলী রজা ওরফে কানুফকির (১৭৫৯-১৮৩৭), শতকে আস্কর আলী পন্ডিত (১৮৪৬-১৯২৭), আবদুল জলিল সিকদার (১৮৫৭-১৯৩৪), সেকান্দর গাইন (১৮৬০-১৯৪২), খাদেম আলী (১৮৭০-১৯৪৭) প্রমুখের গানেও চর্যাপদের পদবিন্যাস লক্ষ করা যায়।
১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত The Origin and Development of the Bengali Language গ্রন্থে ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, পুথিগুলোর মধ্যে কেবল চর্যাপদের ভাষাই বাংলা। চর্যাপদের, প্রতিটি চর্যাই গান এবং রচয়িতা বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য। এঁরা বৌদ্ধ ছিল এমনটি নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। তবে এরা যে বৌদ্ধ লোকধর্মের অনুসারী ছিলেন এবং চট্টগ্রামে অবস্থিত পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয় বা চক্রশালা বিহারে এগুলো লিখেছেন, তা নিশ্চিত। চর্যাসমূহে তাঁরা ‘লোক’ হিসেবে নিজেদের দুঃখ-বেদনা এবং তাঁদের অনুসৃত লোকধর্মকে কেন্দ্র করে ধর্ম-সাধনার কথা ব্যক্ত করেছেন। চট্টগ্রামের আধুনিক লোকগানেও এমন দেখা যায়। আধুনিক মাইজভান্ডারি গান ও চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় লেখা আধ্যাত্মিক গানেও চর্যার প্রভাব এ চরিত্র লক্ষণীয়।
ভাষিক বিশ্লেষণও চর্যাপদকে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক লোকগানের দিকে ইঙ্গিত করে। চর্যাপদ এবং চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার গঠন ও অর্থগত নিবিড়তা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, চর্যাপদ মূলত চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার একটি প্রাচীন কাব্যিক রূপ। যারা চর্যাপদ লিখেছেন তারা ছিলেন বৌদ্ধ বা বৌদ্ধ লোকধর্মের অনুসারী। এরূপ লোকদের অধিকাংশের নিবাস ছিল চট্টগ্রাম। তাই বিশেষজ্ঞদের অভিমত, চর্যাপদ বাংলা ভাষার আদি নির্দশন হলেও এ আদি নিদর্শন চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার মৌলিকতায় সমর্পিত একটি মনোহরী ভাষা।
চর্যাপদের গীতিকাগুলোর সুরছন্দ, লয়তান ও বিন্যাস-দ্যোতনায় চট্টগ্রাম আঞ্চলিক ভাষার গানের অনুভব পাওয়া যায়। চাটিলপাদানং ৫ নম্বর চর্যার চর্যাকার হিসেবে স্বীকৃত। তাকে অনেকে চর্যাকারদের গুরু বলে অভিহিত করেন। ড. সত্যব্রত দে তাঁর লেখা ‘চর্যাগীতি পরিচয়’ গ্রন্থে লিখেছেন, “চাটিল চট্টগ্রামবাসী হইতে পারেন”। আধুনিক
গবেষণায় প্রতীয়মান হয়েছে, দশম শতকে চট্টগ্রামের পন্ডিতবিহারে কাহ্নপাদানং ও শবরপাদানং ছাড়াও আরও কয়েকজন খ্যাতিমান চর্যাকার অধ্যাপনা করতেন। ইত্যাদি বিবেচনায় আমরা বলতে পারি চর্যাপদে চাটিলপাদানং প্রমুখ রচিত চর্যা মূলত চট্টগ্রামের প্রাচীন আঞ্চলিক ভাষায় রচিত চট্টগ্রামের লোকগানের প্রাচীনতম শাখা। হিন্দু আমলের শুরু থেকে পন্ডিত বৌদ্ধবিহারের প্রভাব কমে যেতে শুরু করে। ফলে সিদ্ধাচার্যগণ চট্টগ্রাম ত্যাগ করে আরকানে গিয়ে প্রাচীন বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চা শুরু করেন। যে প্রাচীন ভাষা থেকে নানা বিবর্তনের মাধ্যমে আধুনিক বাংলা ভাষার উৎপত্তি। মধ্যযুগে যা আরও বিকশিত হয়ে ওঠে। চর্যাপদের আদি জন্মভূমি চট্টগ্রাম এবং চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষাতেই চর্যাপদ রচিত। অতএব আমরা বলতে পারি, চট্টগ্রামের আদি আঞ্চলিক ভাষাই বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন।
হাজার থেকে দ্বাদশ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এবং কারও কারও মতে, সপ্তম থেকে অষ্টম খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বাংলা ভাষার উৎপত্তি। ড. শহীদুল্লহর হিসাব অনুযায়ী ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে বাংলা ভাষার আরম্ভকাল। বাংলা ভাষার উৎপত্তি যখনই হোক, চর্যাপদ যে, বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই এবং এর বিপরীতে অন্য কোনো গ্রহণযোগ্য প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত চর্যাপদকেই বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন গণ্য করতে হবে। তাই ‘চর্যাপদ’ অদ্যাবধি বাংলা ভাষার প্রাচীন নিদর্শনের আসনে অধিষ্ঠিত। এখন প্রশ্ন হলো, চর্যাপদ বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন হলে নেপালে গেল কীভাবে? এর উৎস-ভাষা এবং লেখার স্থানই বা কোথায়? বাংলাদেশে বৌদ্ধ ধর্মের আবির্ভাবের প্রারম্ভ হতে চট্টগ্রাম অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও শিক্ষাগত প্রাধান্য ছিল। চর্যাপদের ভাষা, শব্দগঠন, না-বোধক শব্দের অবস্থান, উৎপত্তিগত ইতিহাস, রচয়িতাদের ধর্ম, প্রাকৃতিক পরিবেশ, আধুনিক চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা ও চাটগাঁইয়া ভাষার সাহিত্যকর্ম, আরকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্যচর্চা প্রভৃতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, চট্টগ্রামে চর্যাপদ রচিত হয়েছে এবং চর্যাপদের রচয়িতাগণের অধিকাংশই ছিলেন চট্টগ্রামের অধিবাসী। অধিকন্তু তাঁরা যে দোহা বা চর্যাপদ নামের কাব্য সৃষ্টি করেছেন তা চট্টগ্রামের প্রাচীন আঞ্চলিক ভাষা অনুসরণে রচিত।
১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজকীয় গ্রন্থাগারে হাতে লেখা একটা পুঁথির সন্ধান পেয়েছিলেন। পুঁথিটির নাম ‘আশ্চর্য চর্যাচয়’ বা ‘চর্যাচর্য বিনিশ্চয়’। ‘চর্যাচর্য বিনিশ্চয়’ সাধারণ্যে ‘চর্যাপদ’ নামে পরিচিত। ‘চর্যাপদ’-এর কবিতাগুলো বৌদ্ধ বাউল বা বৌদ্ধ লোকধর্মের অনুসারী। রচয়িতাগণ চর্যাসমূহে বিভিন্ন উপমায় ধর্মীয় বিষয়াদি ব্যাখ্যা করেছেন। অধিকন্তু চর্যাপদে বাংলাদেশের নদ-নদী, পাহাড়, খাল, বিল আর সাধারণ মানুষের কথা, সমাজের সুখ-দুঃখ ও দারিদ্র্যের কথা বিশেষ ভঙ্গিমায় ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস লক্ষণীয়। সবচেয়ে বড়ো কথা হচ্ছে, চর্যাপদের ভাষা আধুনিক বাংলা ভাষার চেয়ে, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গে সমধিক সাযুয্যপূর্ণ।
চট্টগ্রামের বৌদ্ধ ইতিহাস সুপ্রাচীন। সুস্পা কাহ্নপো রচিত ‘পাগসাম-জোন-জন’ ও লামা তারানাথ লিখিত ‘কাবাভদুন দন’ নামের তিববতীয় গ্রন্থে চট্টগ্রামে বৌদ্ধ প্রাধান্য ও তাদের ধর্মমুখী সাহিত্যচর্চার কথা উল্লেখ আছে। ওই গ্রন্থদ্বয় থেকে জানা যায়, চট্টগ্রামের প্রাচীন নাম ‘জালনধারা, যার অপভ্রংশ ‘জলন্দর’, কোথাও কোথাও জুলধা। এই জুলধার কেন্দ্র ছিল বর্তমান কর্ণফুলী নদীর তীরে অবস্থিত কর্ণফুলী উপজেলায়। ওই উপজেলায় এখনও জুলধা নামের একটি গ্রাম রয়েছে। সিন্ধু দেশীয় বৌদ্ধ সিন্ধু বালপাদ চট্টগ্রাম অঞ্চলে কয়েক বছর সাহিত্য সাধনা করেছিলেন বলে জালন্ধরী পাদ বা জুলধা পাদ নামে খ্যাত হয়েছিলেন। তার অপর নাম হাড়িফা। তিনি ঝাড়ুদার হাঁড়ির কাজ করেছিলেন বলে এই নামেও পরিচিত ছিলেন। প্রাচীনকাল হতে সমুদ্রপথে নিরাপদ যাতায়াতোপযোগিতার কারণে ভারতীয় উপমহাদেশ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থল ছিল চট্টগ্রাম। তিনি চট্টগ্রামে এসে বর্তমান চরপাথরঘাটা এলাকায় উঠেছিলেন। জলে যাতায়াত প্রাধান্যের কারণে চট্টগ্রাম জলন্দর নামে অভিহিত হতো। তখনকার চট্টগ্রাম বর্তমান বাংলাদেশের অংশ ছিল না। তখন চট্টগ্রাম ছিল আরকানের অধীন, যে আরকানে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় প্রাচীনকাল হতে বাংলা সাহিত্যচর্চা চলত। নবম শতকের শেষদিকে চট্টগ্রাম পাট্টিকারার চন্দ্রবংশের রাজাদের শাসনাধীনে ছিল এবং পাট্টিকারার চন্দ্র রাজবংশের সাথে আরাকানের চন্দ্রবংশের রাজাদের জ্ঞাতিসম্পর্ক ছিল। অধিকন্তু নেপালের রাজাদের সঙ্গেও ধর্মীয় কারণে সুসম্পর্ক ছিল।
খিস্ট্রীয় আনুমানিক অষ্টম শতকে পূর্ববঙ্গের চট্টগ্রামে পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল। পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয় ছিল উপমহাদেশের একটি প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয় ছিল নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এটি পূর্ববঙ্গে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম বিষয়ের শিক্ষা ও মতবাদ প্রচারের কেন্দ্র হিসেবে পরিচালিত হতো। ত্রয়োদশ শতকে এক সংঘাতে বিহারের নালন্দা বিহার ধ্বংস হয়ে গেলে পূর্ব দেশীয় বৌদ্ধ পন্ডিতবর্গের অনেকে পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। পাল সাম্রাজ্যের বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারক অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান পন্ডিতবিহারে কিছুকাল অবস্থান করেছিলেন।
এখন দেখা যাক, চর্যাপদ কী? তিববত বিশেষজ্ঞ হিসেবে খ্যাত পন্ডিত শরচ্চন্দ্র দাস, লামা তারানাথের তিববতী গ্রন্থ থেকে পন্ডিতবিহার সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। তিনি গ্রন্থ দুটি পর্যালোচনা করে বলেছেন, পূর্ববঙ্গে তথা চট্টগ্রামে মহাযান বা তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মবিষয়ক শিক্ষা ও ধর্মপ্রচারের প্রধান কেন্দ্র ছিল চট্টগ্রাম। মূলত এই কাজ পরিকল্পিতভাবে সুসম্পাদনের জন্য পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকগণ অধ্যাপনা, অধ্যয়ন ও যোগ সাধনার পাশাপাশি অবসর সময়ে যে সব গান-দোঁহা রচনা করেছিলেন তাই পরবর্তীকালে চর্যাপদ নামে বাংলা ভাষা ও বাংলা কাব্যের আদি নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। পন্ডিতবিহারের পূর্বে এবং পরবর্তীকালে আঠারো শতকের মধ্যকাল পর্যন্ত অন্য কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম ইতিহাসে পাওয়া যায় না। অতএব এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, চর্যাপদ চট্টগ্রামে অবস্থিত পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয়ে রচিত হয়েছিল। পন্ডিতবিহারের অবস্থান সম্পর্কে বিভিন্ন মত প্রচলিত রয়েছে। প্রাপ্ত কিছু স্মারক নিদর্শন অনুযায়ী তিব্বত ও বৌদ্ধ সংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ শরচ্চন্দ্র দাসসহ আরও কিছু ইতিহাসবেত্তা ও গবেষকের মতে, অনুমান অষ্টম শতকে চট্টগ্রাম মহানগরের বর্তমান জেনারেল হাসপাতাল সংলগ্ন পাহাড়ে পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল। কারও মতে সীতাকুন্ড উপজেলার চন্দ্রনাথ পাহাড়ে আবার কেউ কেউ মনে করেন, চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার চক্রশালায় অথবা আনোয়ারা উপজেলার দেয়াঙ পাহাড়ের দক্ষিণাংশে ঝিওরী ও হাজিগাঁও গ্রামে পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল। তবে অধিকাংশ যুক্তি-মত, প্রাপ্ত প্রমাণ এবং তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে দেয়াঙ পাহাড়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির অবস্থান ছিল বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। উল্লেখ্য, ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রæয়ারি মাসে আনোয়ারা উপজেলার দেয়াঙ পাহাড়ের নিকটবর্তী ঝিওরী ও হাজিগাঁও গ্রামের সীমান্তে পিতলের ৬৬টি বুদ্ধমূর্তি পাওয়া যায় যা এই স্থানে পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান নিশ্চিত করে। যেখানেই হোক না কেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান যে চট্টগ্রামে ছিল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। বিশেষজ্ঞগণের অভিমত, চট্টগ্রামে অবস্থিত পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদসমূহ রচিত হয়েছিল।
আরাকানের প্রাচীন ইতিহাসসূত্রে জানা যায়, চক্রশালা ছিল আরাকান রাজ্যের আঞ্চলিক সদর দপ্তর। আনোয়ারার দেয়াঙ পাহাড়ে পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পূর্বে অনুমান ২০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে চট্টগ্রামের চক্রশালায় বৌদ্ধ বিহার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এটি ছিল বঙ্গদেশের প্রাচীনতম বিহার। তবে এটি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ছিল না। গৌতমবুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত চক্রশালায় বুদ্ধের জীবিতাবস্থায় একটি বৌদ্ধচক্র নির্মিত হয়েছিল। এই চক্রকে ঘিরে বৌদ্ধ বিহারটি নির্মিত হয়। বৌদ্ধধর্মের প্রচার, ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান এবং অনুসারী সাধারণ লোকদের ধর্মীয় বিধিবিধান সম্পর্কে অবহিত করার জন্য বিহারটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এ বিহারের অন্য একটি উদ্দেশ্য ছিল, আঞ্চলিক ভাষার মাধ্যমে সাধারণ লোকদের সচেতন করা। সংস্কৃতভাষী ব্রাহ্মণদের দৌরাত্ম্য হতে মানুষের মুখের ভাষাকে রক্ষার জন্য গৌতম বুদ্ধই আঞ্চলিক ভাষায় ত্রিপিটক রচনা করে বিশে^ মাতৃভাষা আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন যা তাঁর অনুসারীদের অনুপ্রাণিত করে। ফলে বৌদ্ধপন্ডিতগণ যেখান থেকে চট্টগ্রম বিহারে আসুক না কেন, সাহিত্যচর্চায় চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষাকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন।
যাই হোক, চক্রশালা বিহার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর চক্রশালা পূর্ববঙ্গে সাহিত্যসাধনা ও বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের মিলনকেন্দ্রে পরিণত হয়। সিদ্ধাচার্যগণ এখানে বসে সাধারণ মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত ভাষা তথা প্রাচীন বাংলা ভাষায় বিভিন্ন কবিতা, পদ রচনা করেন। এগুলোই হচ্ছে বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শনের সূচনা। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত অতি অল্প কয়েকটি চর্যাপদ ছাড়া অধিকাংশের হদিস এখনও পাওয়া যায়নি, হয়তো হারিয়ে গেছে। চক্রশালা বিহারে শুধু চর্যা রচিত হতো না, পালি ভাষাতেও নানা শ্লেক রচিত হতো। কিছু কিছু পাদকার পালি ভাষায় এবং কেউ কেউ প্রাচীন বাংলা ভাষায় কবিতা রচনা করতেন। ষষ্ঠদশ শতক থেকে চট্টগ্রামের প্রাচীন আঞ্চলিক ভাষায় বাংলায় কবিতা লেখার প্রচলন বেড়ে যায়। মুদ্রণ যন্ত্র না থাকায় প্রকাশিত পুস্তকাদি হাতে লেখা হতো এবং অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা কারণে এর প্রচার নির্দিষ্ট অঞ্চলে সীমাবদ্ধ থেকে যেত। তাই আঞ্চলিক ভাষায় সাহিত্যকর্ম করলে তা সহজে জনমনে আলোড়ন তুলতে সক্ষম হতো। এ জন্য চর্যাকারগণ মূলত চট্টগ্রামের প্রাচীন আঞ্চলিক ভাষায় সাহিত্য কর্ম করতেন। যার প্রভাব এখনও আরকান, বার্মিজ ভাষা, নেপাল ও ভারতের বিভিন্ন বঙ্গসংলগ্ন রাজ্যে লক্ষণীয়।
চট্টগ্রামে বসে এসব চর্যা বা দোহাগাণ রচিত হয়েছে বলে চর্যাপদের বাক্যের গঠনে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার প্রভাব ব্যাপকভাবে লক্ষ করা যায়। এ প্রসঙ্গে কবি ভূসুকপাদের একটি পদ উল্লেখ করা যায় :
কাহেরে যিনি মেলি আছহ কীস,
বেড়িল পড় অ চৌদীষ।
আপনা মাংস হরিণা বৈরী,
খনহন ছাড় ভূসুক আহেরি।
তিন ন’চ্ছই হরিণা পিবই ন’পানী,
হরিণা হরিণীর নিল অন জানি।
এখানে বর্ণিত আছহ কীস, খনহন ছাড়, ন’চ্ছই ন’পানী, অন জানি প্রভৃতি শব্দগুচ্ছের ব্যবহার কেবল চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা রীতির অনুরূপ। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় না-বোধক শব্দ ক্রিয়ার আগে বসে। যেমন : ন যও, ন চঅ ইত্যাদি। চর্যাচর্য বিনিশ্চয়ের চর্যাসমূহেও ক্রিয়ার আগে না- বোধক পদ ব্যবহৃত হয়েছে। আদি চর্যাকার লুইপা অধিকাংশ চর্যাকারের চর্যায় চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা অনুযায়ী বাক্যগঠন লক্ষণীয়। কুক্কুরীপা, গুন্ডরীপা, ভুসুকুপা, কাহ্নুপা, ডোম্বীপা, শান্তিপা, মহিধরাপাসহ প্রায় সবার চর্যাপদে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার শব্দ বিন্যাস দেখা যায়। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার মতো এখানে ‘না’ শব্দটি ‘ন’ হয়ে ক্রিয়ার আগে বসেছে। বাক্যে শব্দে শব্দে ব্যবহৃত হয়েছে চন্দ্রবিন্দু।
এ প্রসঙ্গে আরও কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যায় : সিট করিঅ মহাসুহ পরিমাণ (লুইপা), ধুলি ধুলি পিটা ধরণ ন জাই (কুক্কুরী পা), জোইণি তঁই বিনু খনহি ন জীবমি (গুন্ডরিপা), খনছ না ছাড়অ ভুসুঅ হেরি, তিন নচ্ছুপাই হরিণা পিবাই ন পাণী (ভুসুকুপা), ভানুই হ্নু মোহিঅহি ন পইসই (কাহ্নপা), ভাবাভাব বলাগ না ছুধ (কাহ্নপা), তান্তি বিকণঅ ডোম্বি অবর ন চঙ্গতা (কাহ্নুপা), করুণা পিহাড়ি খেলছঁ নঅ কল (কৃষ্ণাচার্য পা), আগে নাব ন ভেলা দীসঅ ভাস্তি না পুচ্ছসি নাহা (শান্তিপা), বিদুজণ লোঅ তোঁরে কণ্ঠ ন মেলাঈঁ (কাহ্নুপা) প্রভৃতি।
শুধু এই চর্যাপদ নয়, অধিকাংশ চর্যার বাক্যগঠনে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার গঠনশৈলী, অর্থ ও পরিবেশ-পরিক্রমা লক্ষণীয়। চর্যাচয় বিনিশ্চয় গ্রন্থে ২৩ জন কবির মোট ৫০টি পদ ছিল। কিন্তু হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যে পান্ডুলিপিটি আবিষ্কার করেন সেখানে খন্ডিত ও ছেঁড়া থাকায় সাড়ে ৪৬টি পদ পাওয়া যায়। চর্যাপদ যারা রচনা করেছিলেন তাদের বলা হতো সিদ্ধাচার্য। চর্যাপদের ২৩ জন কবির অধিকাংশের লেখায় চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার শব্দ গঠন রীতি সুস্পষ্ট।
এবার দেখা যাক, বাংলার প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদ কীভাবে নেপাল গেল। পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর চক্রশালা বৌদ্ধবিহারের সমদুয় কাগজপত্র দেয়াঙ পাহাড়ে অবস্থিত পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানান্তর করা হয়। পন্ডিতবিহারের প্রধান অধ্যক্ষ ছিলেন পটিয়া উপজেলার চক্রশালায় জন্মগ্রহণকারী ব্রাহ্মণ সন্তান তিলপাদ। তিনি হিন্দু থেকে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর হিন্দুকালীন যোগসাধন সঙ্গিনী তিল পিষে জীবন ধারণ করতেন। তাই তিনি তিলপাদ নাম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি মহাযান তথা তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করার পর প্রজ্ঞাভদ্র নাম ধারণ করেন। পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয়ের বৌদ্ধ পন্ডিতদের প্রধান কাজ ছিল মহাযান বা তান্ত্রিক বৌদ্ধদের ধর্মীয় বিধি, দোহাগান বা চর্যপদ রচনা, পূজার জন্য দেবদেবীর কম্পনা, মন্ডল আঁকা, স্তব-স্ত্রোত্র, ধারণী মন্ত্র এবং টীকা-টিপ্পনীসহ গ্রন্থাদি রচনা।
পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ প্রজ্ঞাভদ্র, সংস্কৃত, পালি ও চট্টগ্রামের প্রাচীন আঞ্চলিক মিশ্রিত ভাষায় ছয়টি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। গ্রন্থগুলো হচ্ছে, শ্রী সহজ শম্বরস্বাধীষ্টান, অচিন্ত্য মহামুদ্রনাম, তত্ত¡ চতুরোপদেশ প্রসন্নদীপ, যোহা কোষ, ষড় ধর্মোপদেশ এবং মহামন্ত্রোপাদেশ। ইতিহাসবেত্তাদের ধারণা, প্রজ্ঞাভদ্রের জন্মস্থান চট্টগ্রাম হলেও তিনি সারাজীবন চট্টগ্রাম কাটাননি। অনেক ইতিহাসবেত্তা প্রজ্ঞাভভদ্র লিখিত অচিন্ত্য মহামুদ্রনাম গ্রন্থটি বিশ্লেষণ করে বলেছেন, এটি ‘যশঃপালপুরঃ’ নামক স্থানে লিখিত হয়েছিল। স্থানটি চট্টগ্রামে নয় বলে অনেকের অভিমত। কেউ কেউ মনে করেন, স্থানটি নেপালে অবস্থিত। তিনি কোনো বিশেষ কারণে চট্টগ্রাম হতে নেপাল গমন করেছিলেন। অবশ্য এটা ঠিক যে, প্রজ্ঞাভদ্র সারাজীবন পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটাননি। তিনি চট্টগ্রামের পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নেপাল গিয়েছিলেন। নেপাল যাবার সময় পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু গ্রন্থ নিয়ে যান। ওই গ্রন্থসমূহের সঙ্গে চর্যাচর্য বিনিশ্চয় পুথিটিও ছিল যা ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে মহামহোপাধ্যায় হরপপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজকীয় গ্রন্থাগার হতে উদ্ধার করেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর উদ্ধারকারী পুথি ছাড়াও অনুরূপ আরও অনেক পুথি পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল, যা কালের প্রবাহে ও সংরক্ষণের অভাবে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ভাগ্যিস প্রজ্ঞাভদ্র চর্যাচর্য বিনিশ্চয়ের একটা পুথি নেপালে নিয়ে গিয়েছিলেন, বাংলাদেশে থাকলেও ওগুলোও বিলুপ্ত হয়ে যেত।
চট্টগ্রামের লোকগান কত প্রাচীন তা যথার্থভাবে নির্ণয় করা কঠিন হলেও আধুনিক গবেষণায় প্রতীয়মান হয়েছে, চট্টগ্রামের লোকগান চর্যাপদের সমসাময়িক। অনেকের মতে, চর্যাপদের পূর্ব থেকে চট্টগ্রামের লোকগানের উৎপত্তি। পাহাড় নদীর সংগম আর নিজস্ব ভূনের স্বকীয়তা চট্টগ্রামবাসীকে বহুপ্রচীনকাল থেকে লোকগানের প্রতি প্রকৃতিগতভাবে আকৃষ্ট করে রেখেছিল। তাই চট্টগ্রামের লোকগানের ভাষা, অক্ষর ও বিন্যাসের সঙ্গে বাংলার আদি নিদর্শন চর্যাপদের চমৎকার সাযুজ্য ও মিল দেখা যায়।
মধ্যযুগের কবিদের মধ্যে আলাওল, সৈয়দ সুলতান, দৌলত উজির বাহরাম খান, মোহাম্মদ মুকিম, আব্দুল হাকিম প্রমুখ প্রসিদ্ধ কবিদের নাম আমরা পাই। চর্যাপদের সুরের কাছাকাছি সুরের দ্যোতনা দেখা যায় আস্কর আলী পন্ডিতের গানে। তিনি গেয়েছেন : কী জ্বালা দি গেলা মোরে, - - - ন রাখি মাটিতে, ন রাখি পাটিতে ন রাখি পালংকের পরে।’ এমন আরও গান আছে যেমন : ন মাতাই ন বুলাই গেলিরে বন্ধুয়া, মনর আশা ন ফুরালি - - -। এসময়কালের লোকগীতিকার আলী রজা ওরফে কানুফকির (১৭৫৯-১৮৩৭), শতকে আস্কর আলী পন্ডিত (১৮৪৬-১৯২৭), আবদুল জলিল সিকদার (১৮৫৭-১৯৩৪), সেকান্দর গাইন (১৮৬০-১৯৪২), খাদেম আলী (১৮৭০-১৯৪৭) প্রমুখের গানেও চর্যাপদের পদবিন্যাস লক্ষ করা যায়।
১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত The Origin and Development of the Bengali Language গ্রন্থে ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, পুথিগুলোর মধ্যে কেবল চর্যাপদের ভাষাই বাংলা। চর্যাপদের, প্রতিটি চর্যাই গান এবং রচয়িতা বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য। এঁরা বৌদ্ধ ছিল এমনটি নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। তবে এরা যে বৌদ্ধ লোকধর্মের অনুসারী ছিলেন এবং চট্টগ্রামে অবস্থিত পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয় বা চক্রশালা বিহারে এগুলো লিখেছেন, তা নিশ্চিত। চর্যাসমূহে তাঁরা ‘লোক’ হিসেবে নিজেদের দুঃখ-বেদনা এবং তাঁদের অনুসৃত লোকধর্মকে কেন্দ্র করে ধর্ম-সাধনার কথা ব্যক্ত করেছেন। চট্টগ্রামের আধুনিক লোকগানেও এমন দেখা যায়। আধুনিক মাইজভান্ডারি গান ও চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় লেখা আধ্যাত্মিক গানেও চর্যার প্রভাব এ চরিত্র লক্ষণীয়।
ভাষিক বিশ্লেষণও চর্যাপদকে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক লোকগানের দিকে ইঙ্গিত করে। চর্যাপদ এবং চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার গঠন ও অর্থগত নিবিড়তা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, চর্যাপদ মূলত চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার একটি প্রাচীন কাব্যিক রূপ। যারা চর্যাপদ লিখেছেন তারা ছিলেন বৌদ্ধ বা বৌদ্ধ লোকধর্মের অনুসারী। এরূপ লোকদের অধিকাংশের নিবাস ছিল চট্টগ্রাম। তাই বিশেষজ্ঞদের অভিমত, চর্যাপদ বাংলা ভাষার আদি নির্দশন হলেও এ আদি নিদর্শন চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার মৌলিকতায় সমর্পিত একটি মনোহরী ভাষা।
চর্যাপদের গীতিকাগুলোর সুরছন্দ, লয়তান ও বিন্যাস-দ্যোতনায় চট্টগ্রাম আঞ্চলিক ভাষার গানের অনুভব পাওয়া যায়। চাটিলপাদানং ৫ নম্বর চর্যার চর্যাকার হিসেবে স্বীকৃত। তাকে অনেকে চর্যাকারদের গুরু বলে অভিহিত করেন। ড. সত্যব্রত দে তাঁর লেখা ‘চর্যাগীতি পরিচয়’ গ্রন্থে লিখেছেন, “চাটিল চট্টগ্রামবাসী হইতে পারেন”। আধুনিক
গবেষণায় প্রতীয়মান হয়েছে, দশম শতকে চট্টগ্রামের পন্ডিতবিহারে কাহ্নপাদানং ও শবরপাদানং ছাড়াও আরও কয়েকজন খ্যাতিমান চর্যাকার অধ্যাপনা করতেন। ইত্যাদি বিবেচনায় আমরা বলতে পারি চর্যাপদে চাটিলপাদানং প্রমুখ রচিত চর্যা মূলত চট্টগ্রামের প্রাচীন আঞ্চলিক ভাষায় রচিত চট্টগ্রামের লোকগানের প্রাচীনতম শাখা। হিন্দু আমলের শুরু থেকে পন্ডিত বৌদ্ধবিহারের প্রভাব কমে যেতে শুরু করে। ফলে সিদ্ধাচার্যগণ চট্টগ্রাম ত্যাগ করে আরকানে গিয়ে প্রাচীন বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চা শুরু করেন। যে প্রাচীন ভাষা থেকে নানা বিবর্তনের মাধ্যমে আধুনিক বাংলা ভাষার উৎপত্তি। মধ্যযুগে যা আরও বিকশিত হয়ে ওঠে। চর্যাপদের আদি জন্মভূমি চট্টগ্রাম এবং চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষাতেই চর্যাপদ রচিত। অতএব আমরা বলতে পারি, চট্টগ্রামের আদি আঞ্চলিক ভাষাই বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন।
এই সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানার জন্য পড়তে পারেন, আমার লেখা ‘চর্যাপদের উৎসভূমি’ গ্রন্থটি। গ্রন্থটির প্রকাশক, পুথিনিলয়, বাংলাবাজার, ঢাকা। পাওয়া যাবে, অমর একুশে গ্রন্থমেলায় পুথিনিলয় এর স্টলে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক, গবেষক, ইতিহাসবেত্তা, জীবনীকার, ভাষাবিজ্ঞানী ও অনুবাদক। শতাধিক গ্রন্থের প্রণেতা।
No comments:
Post a Comment