Wednesday 20 December 2017

ভালোবাসা শুধুই ভালোবাসা / প্রমিত দাস লাবণী

ভালোবাসা শুধুই ভালোবাসা

ড. মোহাম্মদ আমীনের লেখা একটি গল্পগ্রন্থ। গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার আগে এর তিনটি গল্পে ফেসবুকে প্রকাশিত হয়। তিনটি গল্পই ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে যায়। স্যার আমাকে বিয়ে করুন নামের গল্পটি দিয়ে অনেক চ্যানেল ভিডিও পর্যন্ত তৈরি করে। অর্থনীতির অধ্যাপক সেলসম্যান এবং বউ’ শিরোনামের গল্পটি ফেসবুকে প্রকাশিত হওয়ার বোদ্ধামহলে সাড়া পড়ে যায়। বিদেশি নাম দেখে অনেকের মনে হতে পারে এটি কোনো গল্পের বঙ্গানুবাদ। লেখকের ভাষায়, “এটি কোনো অনুবাদ নয়, আমেরিকায় থাকাকালীন বেস্ট বাই চেইন শপে বাজার করতে গিয়ে গল্পটির প্লট আমার মাথায় আসে।” তাই চরিত্রের নাম বিদেশি। নিচে পাঠকদের জন্য গল্পটি লেখকের অনুমতি নিয়ে প্রকাশ করা হলো। অসাধারণ কিছু গল্প নিয়ে সজ্জিত এই বইটি পড়লে আপনার এবং আপনার উত্তরসুরী- সবার বিবেক আনন্দ আর ঔদার্যে বিকশিত হয়ে উঠবে।  এটি আমি নিশ্চিত বলতে পারি। এ গ্রন্থের আর একটি গল্পের লিংক দিলাম।(https://www.facebook.com/mohammed.amin.714655/posts/1642520929138028?pnref=story)। বইটি পাবেন আগামী (২০১৮) অমর একুশে গ্রন্থমেলায় পুথিনিলয়-এর স্টলে। দাম মাত্র ১২০ টাকা।  গ্রন্থটির প্রচ্ছদ করেছেন মামুন হোসাইন। 

অর্থনীতির অধ্যাপক সেলসম্যান এবং বউ 

ভদ্রলোক দোকানে ঢুকে সেলসম্যানকে বললেন : প্লাস্টিকের একটা টুল নেব। দুই ডলারের বেশি যেন না
হয়। কোনোভাবে আমি দুই ডলারের বেশি খরচ করব না।
সেলসম্যান বলল : আমার নাম কুপার। আমাদের বেস্ট বাই চেইন শপে পৃথিবীর সবদেশের সব ভালো টুল পাবেন। আরামদায়ক, টেকসই এবং আকর্ষণীয় কিন্তু দাম হাতের নাগালে। তিন ডলার খরচ করলে সেরাটা পেয়ে যাবেন। টুল ছাড়া আর কিছু নেবেন না স্যার?
ক্রেতা বললেন : ধন্যবাদ। আমি মোস আর্নেস। ফিলাডেলফিয়া ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক। চিন্তাভাবনা করে খরচ করি। আমাকে কোনো সেলসম্যান গলাতে পারেনি। আপনিও পারবেন না।
: দেখলেই বোঝা যায় আপনি প্রবল ব্যক্তিত্ববান। অপ্রয়োজনীয় সওদা ভালো নয় স্যার। আমি সেলসম্যান হলেও কখনো ক্রেতাকে অনাবশ্যক কিছু কিনতে উদ্বুদ্ধ করি না। নিজের লাভের জন্য অন্যের ক্ষতি করা অপরাধ।
মিস্টার আর্নেস একটা টুল পছন্দ করলেন। সেলসম্যান টুলটি হাতে নিয়ে বললেন : অপূর্ব। অপূর্ব আপনার পছন্দ। এমন সুন্দর টুল কোথায় ব্যবহার করবেন স্যার?
: লেকের পাশে বসে প্রকৃতি দেখব। প্রকৃতি আমার প্রেম।
: প্রকৃতিকে তারাই এভাবে উপভোগ করেন, যারা প্রকৃতির মতো সুন্দর। কিন্তু স্যার, একটা জিনিস বেশিক্ষণ দেখলে ভালো-লাগাটা কমে যায়। এই ধরুন আমার গার্লফ্রেন্ড, প্রথম প্রথম কী যে ভালো লাগত! কণ্ঠ শুনলেই শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে উঠত। এখন গায়ে আছড়ে পড়লেও রোমাঞ্চ আসে না। প্রকৃতির ক্ষেত্রেও এমন ঘটতে পারে।
: কী করতে পারি?
: টুলে বসে মাছ ধরবেন। ফাঁকে ফাঁকে প্রকৃতি দেখবেন। চনাচুর খাবেন, সিগারেট টানবেন, বিয়ার খাবেন, ক্লান্তি এলে বিশ্রাম নেবেন। বিশ্রাম স্বপ্নের বাগান। খুব ভালো লাগবে। কিছু বড়শি দিই স্যার?
: দাও।
বড়শি দিতে দিতে সেলসম্যান বলল : খুব ভালো বড়শি দিলাম। কিন্তু স্যার বড়শি কোথায় বাঁধবেন? আমাদের খুব ভালে সুতো এবং অত্যাধুনিক ছিপ আছে। পছন্দ হবে আপনার। এক সেট দিয়ে দিই?
: দাও।
সেলসম্যান ঝুড়িতে সুতো ও ছিপ রাখতে রাখতে বললেন : অনেকক্ষণ বসে থাকতে হবে। মাংসে ব্যথা হয়ে যেতে পারে। আমাদের দোকানে ভালো কিন্তু সস্তা দামের গদি আছে। বেশ তুলতুলে। আরামের কোনো বিকল্প নেই।
: ঠিক বলেছ। একটা গদি লাগবেই। আমি অফিসের চেয়ারেও গদি ব্যবহার করি।
ধুসর রঙের একটা গদি নামিয়ে সেলসম্যান বলল : স্যার, প্রকৃতি রূপসী মেয়ের মতোই আকর্ষণীয় কিন্তু সেকেন্ডেরও বিশ্বাস নেই। খানিক রোদ, খানিক বৃষ্টি. খানিক ঝড়, খানিক বরফ। হঠাৎ যদি কড়া রোদ উঠে কিংবা ভারী বৃষ্টি হয় তখন কী করবেন?
: তাই তো! কী করব?
: একটা ছাতা এবং একটা সানগ্লাস নিয়ে যান। আমি কী স্যার ভুল বলেছি?
: না। আসলেই প্রয়োজন। দাও এবং কত দাম হলো দেখ। এবার যাব।
: যাবেন স্যার? ছাতার সঙ্গে দুই প্যাকেট চনাচুর, তিন ডজন পানির বোতল, এক ডজন বিয়ার, একটা
ড. মোহাম্মদ আমীন
ফ্লাস্ক, চার সেট কাপ-পিরিস, চারটা চামচ, দুই ব্যাগ চা, আধ কেজি চিনি দিলাম।এগুলি ছাড়া অ্যাংলিং জমে না। আর একটা কথা, এখন না বললে পরে আমার উপর মাইন্ড করবেন। ছোটো টুলটা দিয়ে হবে না। ওটায় চায়ের সরঞ্জাম রাখবেন। আর একটা বড়ো টুল দিলাম। ভারতীয় ঋষির মতো আরাম করে বসতে পারবেন।
: ঠিক আছে। দিয়েছ যখন কী আর করা। তবে অতিরিক্ত কিছু নেব না। আমি অর্থনীতির প্রফেসর।
: স্যার, ধরুন, আপনার বড়শি মাছে টান দিল। বড়ো মাছ। আপনি উত্তেজিত। এসময় হঠাৎ কোনো মশা বা পোকা কামড় দিল, কী হবে? আমি হলে স্যার, একটা ইনসেক্টিসাইড নিতাম।
: সামান্য ইনসেক্টিসাইডের জন্য এত বড়ো মাছটা চলে যাবে। দাও একটা। কিন্তু মাছ বড়ো না ছোটো এটা আমি কীভাবে বুঝব?
: একটা দূরবীন নিয়ে যান। রাতের জন্য টর্চও প্রয়োজন। একটাও অপ্রয়োজনীয় জিনিস নয়। দেব স্যার?
: দাও। আমি অর্থনীতির অধ্যাপক। অপ্রয়োজনীয় কিছু নেব না।
: বৃষ্টি এলে তো ঠান্ডা লেগে যেতে পারে। আমেরিকার বৃষ্টি বাতাস নিয়েই আসে। একটা রেইনকোট গায়ে থাকলে কষ্ট পাবেন না। দেখতেও ভালো দেখাবে। আমাদের সুইস-রেইনকোর্ট আছে। নিয়ে যান স্যার। ভাবীও পছন্দ করবেন।
: দাও। তবে হালকা নীল রঙ। ওই রঙই তোমার ভাবীর পছন্দ।
: অ্যাংলিং খুব টেনশনের বিষয়। শুধু ধূমপান করতে ইচ্ছে করে। সমস্যা সিগারেট নয়, সিগারেটের ছাই। আপনার ব্র্যান্ড?
: বেনসন।
: এক কার্টুন বেনসন, দুটি ম্যাচ এবং একটা অ্যাসট্রে দিলাম স্যার।
: দাও।
: আপনার গাড়িতে কি অ্যাংলিং ক্যাপ আছে?
: নেই।
: ক্যাপ পরে অ্যাংলিং করার মজাই আলাদা। আমি ছুটির দিন গার্ল ফ্রেন্ড অ্যাজারিয়াকে নিয়ে অ্যাঙলিং করি। সে বলে, ক্যাপ ছাড়া নাকি অ্যাংলিং ফুলহীন বাগানের মতো। একটা দিলাম স্যার।
: লাগবে যখন দাও।তবে অতিরিক্ত কিছু নেব না। আমি অর্থনীতির অধ্যাপক।
: আপনি স্যার নিশ্চয় পেনিপেক পার্ক লেকে মাছ ধরবেন, তাই না?
: তুমি কীভাবে জানলে?
: আপনার চেহারা, কথাবার্তা, পেশা আর ব্যক্তিত্ব দেখে মনে হলো এর চেয়ে ভালো লেক ফিলাডেলফিয়ায় থাকলে পেনিলেকেও যেতেন না।
: ঠিক বলেছ। আমি আসলেই সৌখিন।
: অনেক্ষণ মাছ ধরার পর ক্লান্তি আসতে পারে। ক্লান্তি মানে বিশ্রামের আহ্বান। একটা সিংগেল এয়ার মেট্রেস নিয়ে যান। বাতাস ছেড়ে দিলে রুমালের মতো হয়ে যায়। বাসাতেও ব্যবহার করতে পারবেন।
: দাও।
: বিশ্রামে গেলেও স্যার অনেক সময় ঘুম আসে না। আপনাদের মতো বোদ্ধা মানুষের বই ছাড়া ঘুম আসার কথা না। আমার চাচাও অধ্যাপক। তিনি বই ছাড়া বিছানায় যান না। আমাদের দোকানে পৃথিবীর সব দেশের সব ভালো বই আছে। আইজাক ওয়াল্টনের(Izzak Walton) দ্যা কমপ্লেট অ্যাংলার (The Compleat Angler) বইটা নিতে পারেন।
: শুনেছি বইটা ভালো। দাও।বই কখনো অতিরিক্ত হয় না।
: অ্যাংলিং খুব নেশা। ধরুন, আপনার অনেক রাত হয়ে গেল। বাসায় গিয়ে ভাবীকে ডাকলে রাগ করতে পারেন। স্ত্রীদের বিশ্বাস নেই। লেকের পাশে আমাদের একটা হোটেল আছে। খুব ভালো। আপনি ফোন করার সঙ্গে সঙ্গে হোটেলের লোক এসে জামাই আদরে নিয়ে যাবে। একটা রুম বুকিং দিয়ে দিই স্যার?
: দাও।
: সকালে আপনি বাড়ি গেলেন। এতক্ষণ কোথায় ছিলেন কৈফিয়ত চাইতে পারেন ভাবী। মাছ দেখলেও মন গলবে না। বলতে পারেন, মাছ এনেছ মসলাপাতি কই, তেল কই? কিছু মসলা আর ভাবীর জন্য কসমেটিক্স দিই?
: দাও।
: বাচ্চাদের জন্য কী দেব স্যার?
: আমার বাচ্চা নেই।
: তাহলে স্যার বব ডিলনের কয়েকটা ক্যাসেট দিয়ে দিই?
: দাও। তবে অতিরিক্ত কিছু নেব না। আমি অর্থনীতির অধ্যাপক।
: অনেক্ষণ বসে থাকলে কোমড়ে ব্যথা হতে পারে। এক প্যাকেট পেইনকিলার নিয়ে যান। কাজে আসতে পারে। বিপদের বন্ধু।
: দাও।
: বিল কতো হলো?
: দুই হাজার ছয়শ ডলার।
চমকে উঠলেন অধ্যাপক। বিল দিতে যাওয়ার আগে সেলসম্যান কুপার দৌঁড়ে এসে বললেন : বিরাট ভুল হয়ে গেছে। লেন্ডিং নেটস, ক্যাস্ট নেটস, ওজন মাপার স্কেল, ফিশিং রড হোল্ডার, প্লাইয়ারস, গ্রিফার্স, হুক রিমোভার, বাইট এলার্ম, রড কেইস, টিউব, র‌্যাকস এসব নেওয়া হয়নি। এগুলো ছাড়া ফিশিং হয় না। দিয়ে দিচ্ছি স্যার?
: দাও। আমি অর্থনীতির অধ্যাপক। আর কিছু নেব না। মোট কত হলো?
: তিন হাজার পাঁচশ ডলার।
: কিন্তু স্যার আর একটা সমস্যা আছে। এতসব জিনিস দেখলে ভাবী ক্ষেপে যেতে পারেন। তখন কী করবেন?
: তাই তো? কী করব?
: আপনাদের মতো শিক্ষিত লোক বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করতে পারেন না। কিছু বলতেও পারবেন না, কথাগুলি কানে আসবে বজ্র হয়ে। আমি স্যার, একটা জিনিস দেব। ধরেন, আমার পক্ষ থেকে। ওটি নিলে ভাবীর সব চিৎকার অর্থহীন হয়ে যাবে। দেব স্যার? মাত্র পাঁচ ডলার।
: কী সেটা?
: এয়ার মাস্ক। কানে দিলে আণবিক বোমা ফাটলেও শুনবেন না। দেব স্যার?
: দাও। এক্ষুণি লাগিয়ে নিই। যাতে তোমার কথাও কানে না আসে। নইলে ফতুর হয়ে যাব। তুমি বউয়ের চেয়েও মারাত্মক, তোমার কথা বউয়ের চেয়েও ক্ষতিকর।

No comments:

Post a Comment