Tuesday 19 December 2017

তিনে দুয়ে দশ কিশোর উপন্যাসের শেষ অধ্যায় / প্রমিতা দাস লাবণী

তিনে দুয়ে দশ ড. মোহাম্মদ আমীন-এর লেখা একটি কিশোর উপন্যাস। বইটির সার সংক্ষেপ ডিসেম্বরের চার তারিখ Mohammed Amin এর ফেসবুকে প্রকাশের পর রীতিমতো হুলুস্থুল পড়ে গিয়েছিল। লাইক-শেয়ার ছাড়াও গল্পটি হাজার হাজার কপি করে অনেকে নিজেদের টাইম লাইনে নামে-বেনামে চালিয়ে দিতে থাকে। এমনকি CU Friends নামের একটি গ্রপে জনৈক Arshad Uddin নামের একজন লেখকও এটি নিজের নামে পোস্ট করে প্রশংসায় প্রশংসায় ফুলে উঠেন। অনেকে এমন চৌর্যবৃত্তির প্রতিবাদও করেছেন। উপন্যাসটি ছোট, দামও কম; মাত্র ১০০ টাকা। কিন্তু এর ভিতরে যা রয়েছে, তার প্রতিটি লাইন একজন কিশোরকে, একজন অভিভাবককে, একজন শিক্ষককে আদশ চেতনায় ঋদ্ধ করার  পূর্ণ উপাদানে বিভূষিত। এরকম একটি কিশোর উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে আর আছে কিনা আমার জানা নেই। দেখুন বইটির শেষ অধ্যায়।
শেষ অধ্যায়
বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলো। ওমর পনের দিনের জন্য ইউরোপ ভ্রমণে যাবে। আমার পড়ার চাপ বেড়ে গেছে। সেলিমা ছুটি দেয়নি। আকিদ-মুহিবকেও পড়াতে হবে। 
ডিআইজি সাহেব বললেন, পনের দিন পর চলে আসবেন।  আমি সেলিমাকে ফোন করব।
আমি বললাম, আমার জন্য আপনার বাসা অনেক দূরে। সামনে ইয়ার ফাইনাল। ওমরের এখন সমস্যা নেই। একজন ভালো টিচার দিই?
বুসিফেলাসকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আলেকজান্ডার প্রয়োজন। আমার ছেলে বুসেফিলাস, আপনি আলেকজান্ডার।
আমি মেসে চলে এলাম। একা হলে মনে চলে আসে ওমর। তার হাসি, হতভম্ব করে দেওয়া কথা, বুদ্ধিদীপ্ত মন্তব্য, হঠাৎ বিব্রতকর মন্তব্যে মাথা-গরম করে দেওয়া পরিবেশ-- আমাকে ডুবিয়ে রেখেছে ওমরে। সতের কী আঠার দিন পর মেসের বাবুর্চি এসে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, স্যার ওমর আইস্যে। ওঁয়ারে একজন ভদ্দরলোক, মনে অয় ডিআইজি সাব। রাজিব স্যারও আছে।
আমি গিয়ে সালাম দিলাাম।
ওমর সালাম দিল। আমি হতবাক। এ প্রথম সে আমাকে সালাম দিল।
তুমি সালাম দিতে শিখেছ?
ওমর বলল, টিচার, বাবা আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।
তুমি  ডিআইজি স্যারকে বাবা ডাক?
লজ্জার হাসি দিয়ে ওমর বলল,  ডিআইজি কারো বাবা হতে পারে না। আপনি বলেছিলেন, বাবা বাবাই।
ডিআইজি সাহেব বললেন, টিচার, আমার ছেলে বার্ষিক পরীক্ষায় তৃতীয় হয়েছে। কলেজিয়েট স্কুলের মতো প্রতিষ্ঠানে প্রথম হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। ষষ্ঠ থেকে নবম পর্যন্ত তার রোল পঞ্চাশেও ছিল না। এক বছরের মধ্যে আপনি আমার অপদার্থ ছেলেটাকে হীরের টুকরো বানিয়ে দিয়েছেন।
আমি বললাম, আপনার ছেলে হীরে নয়, অ্যান্টিম্যাটার। এস্তেতিনের মতো দুর্লভ। প্রথম দিনেই আমি চিনে ফেলেছিলাম।
আমি জানি না কীভাবে এমন অবিশ্বাস্য পরিবর্তন সম্ভব হলো।
প্রশংসা আমার মনে অদ্ভুত এক আনন্দ বইয়ে দিল। আমি মাটির দিকে তাকিয়ে। মেসের সব সদস্যরা বাইরে এসে ডিআইজি সাহেবকে অভিবাদন জানিয়ে ঘিরে ধরেছে।
মেস ম্যানেজার প্রদীপ বলল, স্যার ভেতরে আসুন ।
ডিআইজি সাহেব মেসে ঢুকে আমার হাতে একটা ঘড়ি তুলে দিয়ে বললেন, ছোট ভাই সুইজারল্যান্ড থেকে এনেছেন। হাতে দিতে গিয়ে দেখলাম, আমার হাতের চেয়ে যোগ্য আর একটা হাত রয়ে গেছে। সে হাতেই কেবল এমন দামি ঘড়ি মানায়। তাই নিয়ে এলাম আপনার হতে পরানোর জন্য। হাতটা দিন, আমি নিজেই পরিয়ে দেব।
বাম হাত এগিয়ে দিতে লজ্জা করছিল, ডান হাত এগিয়ে দিলাম। ডিআইজি সাহেব বললেন, বাম হাত দিন।
তাঁর কথার বিচ্ছুরণ আমাকে এমনভাবে ছুঁয়ে দিচ্ছিল আমি সম্মোহিতের মতো বাম হাতটা এগিয়ে দিলাম। তিনি আমার বাম হাতে ঘড়িটা পরিয়ে দিয়ে বললেন, এটি কোনো বস্তু নয়, ভালোবাসা।
আনন্দে আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। এমনভাবে কেউ আমাকে কোনোদিন উপহার দেননি। স্বর্ণ মোড়ানো রাডো ঘড়িটার দাম অর্ধ লাখের কম নয়।ওমর আমার পায়ে ধরে সালাম করে বলল, স্যার, আপনি আমাকে বদলে দিয়েছেন।
আমি তো টিচার!
আপনি আমার স্যার।
আমি কখনও তোামার স্যার হবো না, টিচার ডাকবে।
ওমর আমার হাতে গিফ্ট্ পেপার মোড়ানো একটা প্যাকেট দিয়ে আবার পা ছুঁয়ে সালাম করে বলল, টিচার, এটি নেন।
কী?
আপনি প্রতিমাসে আমার কাছে যে টাকাগুলো জমা রাখতেন সেগুলো।
ওমরের আচরণ দেখে আমার চোখে সত্যি সত্যি জল এসে গেল। আমি তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলাম, কিছু বলতে পারলাম না। আমার লেখা কবিতার দুটো লাইন নিজের অজান্তে বলে দিলাম,
     স্বপ্ন  যেখানে রুদ্র কঠিন, করাল ভীষণ অন্ধকার
     প্রকৃতি সেখানে মৃণ্ময় বিলাস মিলেমিশে একাকার।
ডিআইজি সাহেব ওমরের এমন আচরণে কেমন জানি আবেগপ্রবণ হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,  টিচার, ওমর আমাকেও পাত্তা দিত না। এ পিচ্চি ছেলের কাছে আমি ছিলাম কেবল ডিআইজি। কোনোদিন ভাবিনি বাবা ডাক শুনব। আপনি তাকে জানোয়ার থেকে মানুষ করে দিয়েছেন। বলুন কী দিয়ে এমন অসম্ভবকে  সম্ভব করেছেন?
আমি বললাম, ভালোবাসা, শুধুই ভালোবাসা।
ডিআইজি সাহেব বললেন, আপনি আমার কাছ থেকে কী চান? গাড়ি-বাড়ি, টাকা, চাকরি, বিদেশ ভ্রমণ? যা চান তাই দেব।  বলুন কী চান?
ভালোবাসা, শুধুই ভালোবাসা।
ওমর বলল, সবার দেওয়া নেওয়া হলো। টিচার আমাকে কিছু দেবেন না?
বললাম, কী চাও?
ভালোবাসা, ভালোবাসা এবং ভালোবাসা।

No comments:

Post a Comment