ভালোবাসা শুধুই ভালোবাসা
ড. মোহাম্মদ আমীনের লেখা একটি গল্পগ্রন্থ। গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার আগে এর তিনটি গল্পে ফেসবুকে প্রকাশিত হয়। তিনটি গল্পই ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে যায়। স্যার আমাকে বিয়ে করুন নামের গল্পটি দিয়ে অনেক চ্যানেল ভিডিও পর্যন্ত তৈরি করে। অর্থনীতির অধ্যাপক সেলসম্যান এবং বউ’ শিরোনামের গল্পটি ফেসবুকে প্রকাশিত হওয়ার বোদ্ধামহলে সাড়া পড়ে যায়। বিদেশি নাম দেখে অনেকের মনে হতে পারে এটি কোনো গল্পের বঙ্গানুবাদ। লেখকের ভাষায়, “এটি কোনো অনুবাদ নয়, আমেরিকায় থাকাকালীন বেস্ট বাই চেইন শপে বাজার করতে গিয়ে গল্পটির প্লট আমার মাথায় আসে।” তাই চরিত্রের নাম বিদেশি। নিচে পাঠকদের জন্য গল্পটি লেখকের অনুমতি নিয়ে প্রকাশ করা হলো। অসাধারণ কিছু গল্প নিয়ে সজ্জিত এই বইটি পড়লে আপনার এবং আপনার উত্তরসুরী- সবার বিবেক আনন্দ আর ঔদার্যে বিকশিত হয়ে উঠবে। এটি আমি নিশ্চিত বলতে পারি। এ গ্রন্থের আর একটি গল্পের লিংক দিলাম।(https://www.facebook.com/mohammed.amin.714655/posts/1642520929138028?pnref=story)। বইটি পাবেন আগামী (২০১৮) অমর একুশে গ্রন্থমেলায় পুথিনিলয়-এর স্টলে। দাম মাত্র ১২০ টাকা। গ্রন্থটির প্রচ্ছদ করেছেন মামুন হোসাইন।
অর্থনীতির অধ্যাপক সেলসম্যান এবং বউ
ভদ্রলোক দোকানে ঢুকে সেলসম্যানকে বললেন : প্লাস্টিকের একটা টুল নেব। দুই ডলারের বেশি যেন না
হয়। কোনোভাবে আমি দুই ডলারের বেশি খরচ করব না।
সেলসম্যান বলল : আমার নাম কুপার। আমাদের বেস্ট বাই চেইন শপে পৃথিবীর সবদেশের সব ভালো টুল পাবেন। আরামদায়ক, টেকসই এবং আকর্ষণীয় কিন্তু দাম হাতের নাগালে। তিন ডলার খরচ করলে সেরাটা পেয়ে যাবেন। টুল ছাড়া আর কিছু নেবেন না স্যার?
ক্রেতা বললেন : ধন্যবাদ। আমি মোস আর্নেস। ফিলাডেলফিয়া ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক। চিন্তাভাবনা করে খরচ করি। আমাকে কোনো সেলসম্যান গলাতে পারেনি। আপনিও পারবেন না।
: দেখলেই বোঝা যায় আপনি প্রবল ব্যক্তিত্ববান। অপ্রয়োজনীয় সওদা ভালো নয় স্যার। আমি সেলসম্যান হলেও কখনো ক্রেতাকে অনাবশ্যক কিছু কিনতে উদ্বুদ্ধ করি না। নিজের লাভের জন্য অন্যের ক্ষতি করা অপরাধ।
মিস্টার আর্নেস একটা টুল পছন্দ করলেন। সেলসম্যান টুলটি হাতে নিয়ে বললেন : অপূর্ব। অপূর্ব আপনার পছন্দ। এমন সুন্দর টুল কোথায় ব্যবহার করবেন স্যার?
: লেকের পাশে বসে প্রকৃতি দেখব। প্রকৃতি আমার প্রেম।
: প্রকৃতিকে তারাই এভাবে উপভোগ করেন, যারা প্রকৃতির মতো সুন্দর। কিন্তু স্যার, একটা জিনিস বেশিক্ষণ দেখলে ভালো-লাগাটা কমে যায়। এই ধরুন আমার গার্লফ্রেন্ড, প্রথম প্রথম কী যে ভালো লাগত! কণ্ঠ শুনলেই শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে উঠত। এখন গায়ে আছড়ে পড়লেও রোমাঞ্চ আসে না। প্রকৃতির ক্ষেত্রেও এমন ঘটতে পারে।
: কী করতে পারি?
: টুলে বসে মাছ ধরবেন। ফাঁকে ফাঁকে প্রকৃতি দেখবেন। চনাচুর খাবেন, সিগারেট টানবেন, বিয়ার খাবেন, ক্লান্তি এলে বিশ্রাম নেবেন। বিশ্রাম স্বপ্নের বাগান। খুব ভালো লাগবে। কিছু বড়শি দিই স্যার?
: দাও।
বড়শি দিতে দিতে সেলসম্যান বলল : খুব ভালো বড়শি দিলাম। কিন্তু স্যার বড়শি কোথায় বাঁধবেন? আমাদের খুব ভালে সুতো এবং অত্যাধুনিক ছিপ আছে। পছন্দ হবে আপনার। এক সেট দিয়ে দিই?
: দাও।
সেলসম্যান ঝুড়িতে সুতো ও ছিপ রাখতে রাখতে বললেন : অনেকক্ষণ বসে থাকতে হবে। মাংসে ব্যথা হয়ে যেতে পারে। আমাদের দোকানে ভালো কিন্তু সস্তা দামের গদি আছে। বেশ তুলতুলে। আরামের কোনো বিকল্প নেই।
: ঠিক বলেছ। একটা গদি লাগবেই। আমি অফিসের চেয়ারেও গদি ব্যবহার করি।
ধুসর রঙের একটা গদি নামিয়ে সেলসম্যান বলল : স্যার, প্রকৃতি রূপসী মেয়ের মতোই আকর্ষণীয় কিন্তু সেকেন্ডেরও বিশ্বাস নেই। খানিক রোদ, খানিক বৃষ্টি. খানিক ঝড়, খানিক বরফ। হঠাৎ যদি কড়া রোদ উঠে কিংবা ভারী বৃষ্টি হয় তখন কী করবেন?
: তাই তো! কী করব?
: একটা ছাতা এবং একটা সানগ্লাস নিয়ে যান। আমি কী স্যার ভুল বলেছি?
: না। আসলেই প্রয়োজন। দাও এবং কত দাম হলো দেখ। এবার যাব।
: যাবেন স্যার? ছাতার সঙ্গে দুই প্যাকেট চনাচুর, তিন ডজন পানির বোতল, এক ডজন বিয়ার, একটা
|
ড. মোহাম্মদ আমীন |
ফ্লাস্ক, চার সেট কাপ-পিরিস, চারটা চামচ, দুই ব্যাগ চা, আধ কেজি চিনি দিলাম।এগুলি ছাড়া অ্যাংলিং জমে না। আর একটা কথা, এখন না বললে পরে আমার উপর মাইন্ড করবেন। ছোটো টুলটা দিয়ে হবে না। ওটায় চায়ের সরঞ্জাম রাখবেন। আর একটা বড়ো টুল দিলাম। ভারতীয় ঋষির মতো আরাম করে বসতে পারবেন।
: ঠিক আছে। দিয়েছ যখন কী আর করা। তবে অতিরিক্ত কিছু নেব না। আমি অর্থনীতির প্রফেসর।
: স্যার, ধরুন, আপনার বড়শি মাছে টান দিল। বড়ো মাছ। আপনি উত্তেজিত। এসময় হঠাৎ কোনো মশা বা পোকা কামড় দিল, কী হবে? আমি হলে স্যার, একটা ইনসেক্টিসাইড নিতাম।
: সামান্য ইনসেক্টিসাইডের জন্য এত বড়ো মাছটা চলে যাবে। দাও একটা। কিন্তু মাছ বড়ো না ছোটো এটা আমি কীভাবে বুঝব?
: একটা দূরবীন নিয়ে যান। রাতের জন্য টর্চও প্রয়োজন। একটাও অপ্রয়োজনীয় জিনিস নয়। দেব স্যার?
: দাও। আমি অর্থনীতির অধ্যাপক। অপ্রয়োজনীয় কিছু নেব না।
: বৃষ্টি এলে তো ঠান্ডা লেগে যেতে পারে। আমেরিকার বৃষ্টি বাতাস নিয়েই আসে। একটা রেইনকোট গায়ে থাকলে কষ্ট পাবেন না। দেখতেও ভালো দেখাবে। আমাদের সুইস-রেইনকোর্ট আছে। নিয়ে যান স্যার। ভাবীও পছন্দ করবেন।
: দাও। তবে হালকা নীল রঙ। ওই রঙই তোমার ভাবীর পছন্দ।
: অ্যাংলিং খুব টেনশনের বিষয়। শুধু ধূমপান করতে ইচ্ছে করে। সমস্যা সিগারেট নয়, সিগারেটের ছাই। আপনার ব্র্যান্ড?
: বেনসন।
: এক কার্টুন বেনসন, দুটি ম্যাচ এবং একটা অ্যাসট্রে দিলাম স্যার।
: দাও।
: আপনার গাড়িতে কি অ্যাংলিং ক্যাপ আছে?
: নেই।
: ক্যাপ পরে অ্যাংলিং করার মজাই আলাদা। আমি ছুটির দিন গার্ল ফ্রেন্ড অ্যাজারিয়াকে নিয়ে অ্যাঙলিং করি। সে বলে, ক্যাপ ছাড়া নাকি অ্যাংলিং ফুলহীন বাগানের মতো। একটা দিলাম স্যার।
: লাগবে যখন দাও।তবে অতিরিক্ত কিছু নেব না। আমি অর্থনীতির অধ্যাপক।
: আপনি স্যার নিশ্চয় পেনিপেক পার্ক লেকে মাছ ধরবেন, তাই না?
: তুমি কীভাবে জানলে?
: আপনার চেহারা, কথাবার্তা, পেশা আর ব্যক্তিত্ব দেখে মনে হলো এর চেয়ে ভালো লেক ফিলাডেলফিয়ায় থাকলে পেনিলেকেও যেতেন না।
: ঠিক বলেছ। আমি আসলেই সৌখিন।
: অনেক্ষণ মাছ ধরার পর ক্লান্তি আসতে পারে। ক্লান্তি মানে বিশ্রামের আহ্বান। একটা সিংগেল এয়ার মেট্রেস নিয়ে যান। বাতাস ছেড়ে দিলে রুমালের মতো হয়ে যায়। বাসাতেও ব্যবহার করতে পারবেন।
: দাও।
: বিশ্রামে গেলেও স্যার অনেক সময় ঘুম আসে না। আপনাদের মতো বোদ্ধা মানুষের বই ছাড়া ঘুম আসার কথা না। আমার চাচাও অধ্যাপক। তিনি বই ছাড়া বিছানায় যান না। আমাদের দোকানে পৃথিবীর সব দেশের সব ভালো বই আছে। আইজাক ওয়াল্টনের(Izzak Walton) দ্যা কমপ্লেট অ্যাংলার (The Compleat Angler) বইটা নিতে পারেন।
: শুনেছি বইটা ভালো। দাও।বই কখনো অতিরিক্ত হয় না।
: অ্যাংলিং খুব নেশা। ধরুন, আপনার অনেক রাত হয়ে গেল। বাসায় গিয়ে ভাবীকে ডাকলে রাগ করতে পারেন। স্ত্রীদের বিশ্বাস নেই। লেকের পাশে আমাদের একটা হোটেল আছে। খুব ভালো। আপনি ফোন করার সঙ্গে সঙ্গে হোটেলের লোক এসে জামাই আদরে নিয়ে যাবে। একটা রুম বুকিং দিয়ে দিই স্যার?
: দাও।
: সকালে আপনি বাড়ি গেলেন। এতক্ষণ কোথায় ছিলেন কৈফিয়ত চাইতে পারেন ভাবী। মাছ দেখলেও মন গলবে না। বলতে পারেন, মাছ এনেছ মসলাপাতি কই, তেল কই? কিছু মসলা আর ভাবীর জন্য কসমেটিক্স দিই?
: দাও।
: বাচ্চাদের জন্য কী দেব স্যার?
: আমার বাচ্চা নেই।
: তাহলে স্যার বব ডিলনের কয়েকটা ক্যাসেট দিয়ে দিই?
: দাও। তবে অতিরিক্ত কিছু নেব না। আমি অর্থনীতির অধ্যাপক।
: অনেক্ষণ বসে থাকলে কোমড়ে ব্যথা হতে পারে। এক প্যাকেট পেইনকিলার নিয়ে যান। কাজে আসতে পারে। বিপদের বন্ধু।
: দাও।
: বিল কতো হলো?
: দুই হাজার ছয়শ ডলার।
চমকে উঠলেন অধ্যাপক। বিল দিতে যাওয়ার আগে সেলসম্যান কুপার দৌঁড়ে এসে বললেন : বিরাট ভুল হয়ে গেছে। লেন্ডিং নেটস, ক্যাস্ট নেটস, ওজন মাপার স্কেল, ফিশিং রড হোল্ডার, প্লাইয়ারস, গ্রিফার্স, হুক রিমোভার, বাইট এলার্ম, রড কেইস, টিউব, র্যাকস এসব নেওয়া হয়নি। এগুলো ছাড়া ফিশিং হয় না। দিয়ে দিচ্ছি স্যার?
: দাও। আমি অর্থনীতির অধ্যাপক। আর কিছু নেব না। মোট কত হলো?
: তিন হাজার পাঁচশ ডলার।
: কিন্তু স্যার আর একটা সমস্যা আছে। এতসব জিনিস দেখলে ভাবী ক্ষেপে যেতে পারেন। তখন কী করবেন?
: তাই তো? কী করব?
: আপনাদের মতো শিক্ষিত লোক বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করতে পারেন না। কিছু বলতেও পারবেন না, কথাগুলি কানে আসবে বজ্র হয়ে। আমি স্যার, একটা জিনিস দেব। ধরেন, আমার পক্ষ থেকে। ওটি নিলে ভাবীর সব চিৎকার অর্থহীন হয়ে যাবে। দেব স্যার? মাত্র পাঁচ ডলার।
: কী সেটা?
: এয়ার মাস্ক। কানে দিলে আণবিক বোমা ফাটলেও শুনবেন না। দেব স্যার?
: দাও। এক্ষুণি লাগিয়ে নিই। যাতে তোমার কথাও কানে না আসে। নইলে ফতুর হয়ে যাব। তুমি বউয়ের চেয়েও মারাত্মক, তোমার কথা বউয়ের চেয়েও ক্ষতিকর।
‘তিনে দুয়ে দশ’ ড. মোহাম্মদ আমীন-এর লেখা একটি অনবদ্য কিশোর উপন্যাস। কিশোরদের
|
ড. মোহাম্মদ আমীন |
মনমানসিকতাকে আদর্শ চেতনায় জাগ্রত করতে হলে তাদের কেমন হতে হয়, সেটি ছাড়াও এ বিষয়ে অভিভাবক, শিক্ষক ও সমাজের কর্তব্য কী, তা অতি হৃদয়গ্রাহী ভাষায় অনুপম এক গল্পের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। লেখকের জীবন থেকে নেওয়া এই গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে পুথিনিলয়। পাওয়া যাবে আগামী ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের অমর একুশে গ্রন্থমেলার পুথিনিলয় স্টলে। প্রচ্ছদ করেছেন মামুন হোসাইন। শুধু উপন্যাসটি নয়, ভূমিকাও অনবদ্য। হায়ৎ মামুদের লেখা ভূমিকা পড়লে আপনার অনুভূতিতে অন্যরকম আলোড়ন সৃষ্টি হবে। এমন ভূমিকা আমি আর কখনো পড়িনি। দেখুন, কেমন বইটর ভূমিকা।
ভূমিকা
|
অধ্যাপক ড. হায়াৎ মামুদ |
‘তিনে দুয়ে দশ’ কীভাবে হয়?
ড. মোহাম্মদ আমীন বললেন, পড়ে দেখুন।
বই পড়তে পড়তে বুড়ো হয়ে গেলাম, কী আর পড়ব! ভেবেছিলাম, দুই এক পৃষ্ঠা পড়ে একটা ভূমিকা লিখে দেব। পারলাম না, ইচ্ছাকে প্রতিহত করা কঠিন কাজ। প্রথম অধ্যায় শেষ করার পর দ্বিতীয় অধ্যায়, আমাকে এমনভাবে টানতে লাগল যে, স্থির থাকতে পারলাম না। অধীর আগ্রহে ঝাঁপ দিলাম দ্বিতীয় অধ্যায়ে। শব্দ চয়ন, কথোপকথন, টানটান ঘটনা পরম্পরা, কিশোর ওমরের বুদ্ধিদীপ্ত পদচারণা-দুষ্টময় উদ্ভাস, সেলিমার বিচক্ষণতা এবং শিক্ষকের কুশলী ধৈর্য আমাকে বিমোহিত করে দিল। পড়তে পড়তে, আমি বুড়ো বয়সেও কিশোরের মতো চঞ্চল হয়ে উঠলাম। অনিচ্ছারাশি আগ্রহের চূড়োয় উঠে গেল। কৈশোরময় আগ্রহে নিজেকে হারিয়ে ফেলি। আমি এগিয়ে যাচ্ছি কৈশোর হতে কৈশোরে। হঠাৎ দেখি উপন্যাস শেষ হয়ে গেল?
এত তাড়াতাড়ি শেষ করে দিলে যে?
লেখক বললেন, কিশোর বয়স তো তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়।
আমি বললাম, না। এমন বুদ্ধিদীপ্ত বইয়ের মাধ্যমে যে কোনো বয়সকে কৈশোরের মতো প্রাণবন্ত
সজীবতায় চিরন্তন করে রাখা যায়। তোমার, ‘দুয়ে তিনে দশ’ উপন্যাসটি আমার অশীতিপর বৃদ্ধত্বকেও ষোড়শোন্মদনায় প্রকৃতির মতো নির্ঝর উচ্ছ্বাসে কিশোর করে দিয়েছিল।
সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে লেখা কিশোর উপন্যাসটি কিশোরদের শুধু আনন্দ দেবে না, বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার অনুপ্রেরণাও জোগাবে। সর্বোপরি, কিশোরদের সঙ্গে মা-বাবা ও পরিবেশের মধ্যে কেমন সম্পর্ক হওয়া উচিত -- তাও অনবদ্য বাস্তবতায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এমন একটি কিশোর উপন্যাস পড়তে পেরে আমি সত্যি বিমোহিত।
অধ্যাপক হায়াৎ মামুদ
তিনে দুয়ে দশ ড. মোহাম্মদ আমীন-এর লেখা একটি কিশোর উপন্যাস। বইটির সার সংক্ষেপ ডিসেম্বরের চার তারিখ Mohammed Amin এর ফেসবুকে প্রকাশের পর রীতিমতো হুলুস্থুল পড়ে গিয়েছিল। লাইক-শেয়ার ছাড়াও গল্পটি হাজার হাজার কপি করে অনেকে নিজেদের টাইম লাইনে নামে-বেনামে চালিয়ে দিতে থাকে। এমনকি CU Friends নামের একটি গ্রপে জনৈক Arshad Uddin নামের একজন লেখকও এটি নিজের নামে পোস্ট করে প্রশংসায় প্রশংসায় ফুলে উঠেন। অনেকে এমন চৌর্যবৃত্তির প্রতিবাদও করেছেন। উপন্যাসটি ছোট, দামও কম; মাত্র ১০০ টাকা। কিন্তু এর ভিতরে যা রয়েছে, তার প্রতিটি লাইন একজন কিশোরকে, একজন অভিভাবককে, একজন শিক্ষককে আদশ চেতনায় ঋদ্ধ করার পূর্ণ উপাদানে বিভূষিত। এরকম একটি কিশোর উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে আর আছে কিনা আমার জানা নেই। দেখুন বইটির শেষ অধ্যায়।
শেষ অধ্যায়
বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলো। ওমর পনের দিনের জন্য ইউরোপ ভ্রমণে যাবে। আমার পড়ার চাপ বেড়ে গেছে। সেলিমা ছুটি দেয়নি। আকিদ-মুহিবকেও পড়াতে হবে।
ডিআইজি সাহেব বললেন, পনের দিন পর চলে আসবেন। আমি সেলিমাকে ফোন করব।
আমি বললাম, আমার জন্য আপনার বাসা অনেক দূরে। সামনে ইয়ার ফাইনাল। ওমরের এখন সমস্যা নেই। একজন ভালো টিচার দিই?
বুসিফেলাসকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আলেকজান্ডার প্রয়োজন। আমার ছেলে বুসেফিলাস, আপনি আলেকজান্ডার।
আমি মেসে চলে এলাম। একা হলে মনে চলে আসে ওমর। তার হাসি, হতভম্ব করে দেওয়া কথা, বুদ্ধিদীপ্ত মন্তব্য, হঠাৎ বিব্রতকর মন্তব্যে মাথা-গরম করে দেওয়া পরিবেশ-- আমাকে ডুবিয়ে রেখেছে ওমরে। সতের কী আঠার দিন পর মেসের বাবুর্চি এসে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, স্যার ওমর আইস্যে। ওঁয়ারে একজন ভদ্দরলোক, মনে অয় ডিআইজি সাব। রাজিব স্যারও আছে।
আমি গিয়ে সালাম দিলাাম।
ওমর সালাম দিল। আমি হতবাক। এ প্রথম সে আমাকে সালাম দিল।
তুমি সালাম দিতে শিখেছ?
ওমর বলল, টিচার, বাবা আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।
তুমি ডিআইজি স্যারকে বাবা ডাক?
লজ্জার হাসি দিয়ে ওমর বলল, ডিআইজি কারো বাবা হতে পারে না। আপনি বলেছিলেন, বাবা বাবাই।
ডিআইজি সাহেব বললেন, টিচার, আমার ছেলে বার্ষিক পরীক্ষায় তৃতীয় হয়েছে। কলেজিয়েট স্কুলের মতো প্রতিষ্ঠানে প্রথম হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। ষষ্ঠ থেকে নবম পর্যন্ত তার রোল পঞ্চাশেও ছিল না। এক বছরের মধ্যে আপনি আমার অপদার্থ ছেলেটাকে হীরের টুকরো বানিয়ে দিয়েছেন।
আমি বললাম, আপনার ছেলে হীরে নয়, অ্যান্টিম্যাটার। এস্তেতিনের মতো দুর্লভ। প্রথম দিনেই আমি চিনে ফেলেছিলাম।
আমি জানি না কীভাবে এমন অবিশ্বাস্য পরিবর্তন সম্ভব হলো।
প্রশংসা আমার মনে অদ্ভুত এক আনন্দ বইয়ে দিল। আমি মাটির দিকে তাকিয়ে। মেসের সব সদস্যরা বাইরে এসে ডিআইজি সাহেবকে অভিবাদন জানিয়ে ঘিরে ধরেছে।
মেস ম্যানেজার প্রদীপ বলল, স্যার ভেতরে আসুন ।
ডিআইজি সাহেব মেসে ঢুকে আমার হাতে একটা ঘড়ি তুলে দিয়ে বললেন, ছোট ভাই সুইজারল্যান্ড থেকে এনেছেন। হাতে দিতে গিয়ে দেখলাম, আমার হাতের চেয়ে যোগ্য আর একটা হাত রয়ে গেছে। সে হাতেই কেবল এমন দামি ঘড়ি মানায়। তাই নিয়ে এলাম আপনার হতে পরানোর জন্য। হাতটা দিন, আমি নিজেই পরিয়ে দেব।
বাম হাত এগিয়ে দিতে লজ্জা করছিল, ডান হাত এগিয়ে দিলাম। ডিআইজি সাহেব বললেন, বাম হাত দিন।
তাঁর কথার বিচ্ছুরণ আমাকে এমনভাবে ছুঁয়ে দিচ্ছিল আমি সম্মোহিতের মতো বাম হাতটা এগিয়ে দিলাম। তিনি আমার বাম হাতে ঘড়িটা পরিয়ে দিয়ে বললেন, এটি কোনো বস্তু নয়, ভালোবাসা।
আনন্দে আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। এমনভাবে কেউ আমাকে কোনোদিন উপহার দেননি। স্বর্ণ মোড়ানো রাডো ঘড়িটার দাম অর্ধ লাখের কম নয়।ওমর আমার পায়ে ধরে সালাম করে বলল, স্যার, আপনি আমাকে বদলে দিয়েছেন।
আমি তো টিচার!
আপনি আমার স্যার।
আমি কখনও তোামার স্যার হবো না, টিচার ডাকবে।
ওমর আমার হাতে গিফ্ট্ পেপার মোড়ানো একটা প্যাকেট দিয়ে আবার পা ছুঁয়ে সালাম করে বলল, টিচার, এটি নেন।
কী?
আপনি প্রতিমাসে আমার কাছে যে টাকাগুলো জমা রাখতেন সেগুলো।
ওমরের আচরণ দেখে আমার চোখে সত্যি সত্যি জল এসে গেল। আমি তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলাম, কিছু বলতে পারলাম না। আমার লেখা কবিতার দুটো লাইন নিজের অজান্তে বলে দিলাম,
স্বপ্ন যেখানে রুদ্র কঠিন, করাল ভীষণ অন্ধকার
প্রকৃতি সেখানে মৃণ্ময় বিলাস মিলেমিশে একাকার।
ডিআইজি সাহেব ওমরের এমন আচরণে কেমন জানি আবেগপ্রবণ হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, টিচার, ওমর আমাকেও পাত্তা দিত না। এ পিচ্চি ছেলের কাছে আমি ছিলাম কেবল ডিআইজি। কোনোদিন ভাবিনি বাবা ডাক শুনব। আপনি তাকে জানোয়ার থেকে মানুষ করে দিয়েছেন। বলুন কী দিয়ে এমন অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন?
আমি বললাম, ভালোবাসা, শুধুই ভালোবাসা।
ডিআইজি সাহেব বললেন, আপনি আমার কাছ থেকে কী চান? গাড়ি-বাড়ি, টাকা, চাকরি, বিদেশ ভ্রমণ? যা চান তাই দেব। বলুন কী চান?
ভালোবাসা, শুধুই ভালোবাসা।
ওমর বলল, সবার দেওয়া নেওয়া হলো। টিচার আমাকে কিছু দেবেন না?
বললাম, কী চাও?
ভালোবাসা, ভালোবাসা এবং ভালোবাসা।