Sunday, 31 January 2016

ড. মোহাম্মদ আমীন আমাদের গর্ব / মো: আব্দুস সালাম খান

. মোহাম্মদ আমীনের চকরিয়ার ইতিহাস অভয়নগরের ইতিহাস গ্রন্থে যে সকল চমৎকার তথ্য লিপিবদ্ধ হয়েছে, তা পড়ে মুগ্ধ হতে হয়। পুঁটি মাছের মুখ দিয়েপৃথিবীতে
একমাত্র মানুষই নিজের মলমূত্র খায়বলিয়ে যেভাবে মানুষের বিবেককে জাগিয়ে  তুলতে চেষ্টা করা হয়েছে তাতে স্যানিটেশন সম্পর্কে মানুষ সচেতন না হয়ে পারেন না। তার গ্রন্থসমূহে অতীতকে জানার এবং সুন্দর ভবিষ্যৎ রচনার জন্য মানব সমাজকে সাহায্য করবে বলে আমি বিশ্বাস করিসাহিত্য চর্চায় তার মেধা ও শ্রম কাজে লাগিয়ে মানব কল্যাণে তিনি আরও ব্রতী হবেন- এটাই আমাদের প্রত্যাশা। তার সাধানা তাকে খ্যাতির উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করবে এটাই কামনা করি।
জনাব আমীনের লেখা  ‘বনমামলা দায়ের ও পরিচালনার কৌশল’ এবং ‘ম্যাজিস্ট্রেসি ও আদেশনামা’ বইদুটো আমাদের সহকর্মীদের দৈনন্দিন কর্তব্যপালনে উপকারে আসবে। বই দুটো প্রশাসনে নিয়োজিত উদীয়মান কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি কার্যক্রমে আরও সুদক্ষ করে তুলতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে আমি মনে করি। তিনি নিজের অভিজ্ঞতা হতে বই দুটি রচনা করেছেন। জনাব মোহাম্মদ আমীন আমাদের গর্ব। আমি তার চমৎকার লেখার প্রশংসা করছি। তার এ কর্ম প্রচেষ্টা অন্যদেরকে বই লিখতে অনুপ্রাণিত করবে।
কর্মক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি জনাব আমীনের সাহিত্য চর্চায় আমি মুগ্ধ। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ম্যাজিস্ট্রেসির পাশাপাশি সাহিত্য চর্চা করে বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে আছেন। ‘তিলোত্তমা হাতিয়া’ যিনি লিখেত পারেন তার পক্ষে বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী আসন লাভ করা অসম্ভব নয়। তার জন্য আমি গর্ববোধ করি।

লেখক : মো: আব্দুস সালাম খান, প্রাক্তন সচিব, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও  রেক্টর, বিপিএটিসি, সাভার, ঢাকা ও প্রাক্তন জেলাপ্রশাসক, চট্টগ্রাম।

হাতিয়ার নামকরণ / ড. মোহাম্মদ আমীন

 হাতিয়ার নামকরণ সম্পর্কে একাধিক প্রবাদ প্রচলিত আছে প্রবাদগুলো যেমন মজার তেমন আকর্ষণীয় ঐতিহাসিক তথ্য বাস্তবতা সমৃদ্ধ প্রবাদ-উপখ্যানগুলো সংশ্লিষ্ট প্রবক্তরা গ্রহণযোগ্য করার প্রয়াসে যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যাও সংযুক্ত করেছেন কেউ কেউ প্রবাদগুলোকে নিছক গাল-গল্প মনে করলেও অধিকাংশ লোকই বাদগুলো সত্য বলে মনে
করেনহাতিয়ার নামকরণ প্রবাদের দুটি প্রধান ধারা লক্ষণীয়- তৎমধ্যে একটিহাটিয়াএবং অন্যটিহাতিপ্রবাদ নামে খ্যাত এছাড়া আরও একাধিক  প্রবাদ শোনা যায় নামকরণ প্রবাদগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন প্রবাদহাটিয়াপ্রবাদ হলেও অধিকাংশ লোকহাতিপ্রবাদ এর সমর্থক কতিপয় প্রবাদ দৃষ্টে পঞ্চদশ এবং ষোড়শ শতকে হাতিয়া নামকরণ হয়েছে বলে দেখা যায় কিন্তু আধুনিক গবেষণায় প্রতীয়মান হয়েছে যে, হাতিয়ার নামকরণ অবশ্যই ১৫০ খ্রিস্টাব্দ বা তার পূর্বের। ১৫০ খ্রিস্টাব্দে টলেমির বিবরণে হাতিয়ার উল্লেখ আছে (কাজী মোজাম্মেল হক বিরচিত তিন হাজার বছরের নোয়াখালী গ্রন্থের ৫ম পৃষ্ঠার উদ্ধৃতি) তাই হাতিয়ার নামকরণ বিষয়ে ১৫০ খ্রিস্টব্দের পরের প্রবাদগুলো গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
 প্রবাদমতে হাতিয়ার প্রাচীন নাম ছিল সাগরদ্বীপ, যার অপভ্রংশ সাগরদীহি> সাগরদী ইতিহাসও অনুরূপ সাক্ষ্য দেয় খ্রিস্টপূর্ব আনুমানিক ২০০০-১৫০০ অব্দ পর্যন্ত দ্বীপটির কোনো নাম ছিল বলে মনে হয় না কিরাতরা নামহীন দ্বীপটিতে এসে বসবাস শুরু করার পর আদিবাসী কিরাতরাই সর্বপ্রথম সাগর হতে সৃষ্ট সুন্দর দ্বীপটির নাম সাগরদ্বীপ রেখেছিল। সাগরদ্বীপ হতে সাগরদীহি পরবর্তীকালে সাগরদী নাম এলাকার উৎপত্তি হয় মহাভারত যুগের পূর্বে পর্যন্ত বর্তমান হাতিয়ার সাগরদ্বীপ নাম অক্ষুণ্ন ছিল মহাভারত যুগের প্রারম্ভকালে সাগরদ্বীপ নাম পরিবর্তিত হয়েরামচরণনাম ধারণ করে 
কথিত হয়, রামের প্রপিতামহ রঘু এ অঞ্চলে অনার্যদের (মহাভারতের রাক্ষসঃ আর্যরা অনার্যদের রাক্ষস, হনুমান ইত্যাদি বলত) বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার সময় হাতিয়া অবস্থান করেছিলেন রাবন সীতাকে অপহরণ করে চট্টগ্রাম (বর্তমানে সীতাকুণ্ড) নিয়ে যাওয়ার পথে নিরাপদ ভেবে কিছুদিন সাগরদ্বীপ নামক নির্জন দ্বীপটিতে আত্মগোপন করেছিলেন রাম সীতার সন্ধানে বের হয়ে সংবাদ পান যে, সীতা সাগরদ্বীপে (হাতিয়া) আছেন তিনি দ্রুত সাগরদ্বীপ আগমন করেন রাম সাগরদ্বীপে এসে মাটিতে চরণ রাখার সাথে সাথে রাবন সীতাকে নিয়ে সাগরদ্বীপ (হাতিয়া) ত্যাগ করেন রাম যেখানে চরণ রেখেছিলেন সে এলাকা পরবর্তীকালেরামচরণনামে খ্যাতি পায় 
মহাভারত যুগ হতে শুরু করে পরবর্তী একদশক পর্যন্ত সাগরদ্বীপে রামচরণ এলাকা সাগরদী নামকে অনেকটা ঢেকে রেখেছিল প্রবাদটির পক্ষে মহাভারতের আলোকে ওয়েবষ্ঠারের " The Mahabharata records a hurricane cempaign of Bhim, who exacted tribute and took precious gems of various kinds who ruled over the sea costsএবং প্লিনির প্রেরিপ্লাস গ্রন্থের উদ্ধৃতিtour of conquest of India by
নিঝুম দ্বীপ
Roughu, the great grandfather of Ram, strating from Auyodna he went eastward to ocean having conquered Bangalis”
প্রনিধাণযোগ্য প্রাচীনকালে  গঙ্গা নামের একটি নদী (পরবর্তীতে রাধাখালী) হাতিয়া সংলগ্ন দ্বীপগুলোর পাশ দিয়ে এঁকে বেঁকে প্রবাহিত হত অবশ্য পরে নদীটি হেজেমেজে খালে রূপান্তরিত হয়ে যমুনা নামের অন্য একটি নদীর জন্ম দেয় 
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে অস্ত্র খালাসের অন্যতম পিক পয়েন্ট হিসেবেও রাধাখালি খাল আরেকবার বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল মূল গঙ্গা এবং অন্য একটি নদীর মোহনার সমন্বিত মিলনের এক অলৌকিক সৃষ্টি ছিল এনদী নদীটির দুই পাড় খুবই চমৎকার বালিময় ছিল বছরের যে কোনো সময় এখানে ভ্রমণ করার মতো পর্যাপ্ত সুবিধা বিদ্যমান থাকত দুতীরের অসংখ্য বৃক্ষ, ফলজ গুল্ম, ফুলের বাগান, প্রাকৃতিক সুঘ্রাণ, নদীর কলহাস্য, বিহগের কাকলী ইত্যাদি নদীটিকে আর্য তথা রামায়ন-মহাভারতের উল্লেখিত দেব-দেবীর প্রিয় ভ্রমণ তীর্থে পরিণত করেছিল নদীটি দেশ জয় এবং অসুরদের (অনার্য) আক্রমণ প্রতিহত করার একটি অত্যত্তুম কৌশলগত স্থান হিসাবেও ব্যবহৃত হতো পান্ডব বীর ভিম সদলবলে নদী তীরে অবকাশ কাটাতেন বলে প্রাকৃতিক সম্ভারের সাথে রাজকীয় পরিচর্যা যুক্ত হয়ে নদীটি হয়ে উঠেছিল  শ্রেষ্ঠতম পর্যটন কেন্দ্র রাধা-কৃষ্ণ মোহনায় বেশীর ভাগ সময় মিলিত হয়ে প্রকৃতিকে উপভোগ করতেন কৃষ্ণের বাঁশীর সুরে মাতোয়ারা হয়ে উঠত পুরো নদী, জল আর এলাকাযমুনা পুলিনে শ্যাম, মুরুলীতে অবিরাম, রাধা নামে সুর মুরছায়, রাখো মিনতি রাঙ্গা পায়লতা মুঙ্গেশকরের বিখ্যাত গানটিসহ আরও অনেক শ্যামা সংগীতে এর প্রমাণ মিলে বড়ুচন্ডীদাশের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বা কৃষ্ণসন্দর্ব্ব প্রভৃতি গ্রন্থে রাধা-কৃঞ্চের প্রেমলীলার বিবরণে যে স্থানটির ইঙ্গিত পাওয়া যায় তা এখানে বর্ণিত রাধাখালি নদীর কথায় চিহ্নিত করে  রাধা নদীতে প্রেমলীলা করতেন এবং রাধা চলে যাওয়ার পর ভক্তরা নদীটির নাম রাধাখালী রাখে যার অর্থ রাধা নেই 
১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ফ্যান ডেন্ ব্রৃক এর মানচিত্রে টলেমি কর্তৃক বর্ণিত এন্টিবোলকে (গঙ্গা) ‘দ্যা বুমনামে পরিচিহ্নিত করা হয়েছে সময় গঙ্গার শাখাটি সন্দ্বীপ হাতিয়ার গাঁ ঘেষে ফরিদপুরের মধ্য দিয়ে বাখরগঞ্জ জেলার নিকট বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত হয়ে প্রবাহিত হতো তখন হতে মেঘনার নাম শুনা যায় এর পূর্বে মেঘনা বলে কোনো নদীর অস্তিত্ব ছিল না ডাকাতিয়া মেঘনার মিলিত স্রোত ঘাগরা নামে পরিচিত ছিল চর বংশী, চর আবাবিল, চর আবুদিসহ আরও ছোটবড় কয়েকটি দ্বীপ জেগে উঠায় ডাকাতিয়া মেঘনা বিচিছন্ন স্রোতধারায় পরিণত হয় 
 দক্ষিণ আমেরিকার স্বাধীন দেশহাইতির নামকরণের সাথে বাংলাদেশেরহাতিয়ানামকরণের একটা সাযুস্য আছে বলে ঐতিহাসিক বিশ্লেষকদের ধারণা যে কারণেহাইতিনামকরণ ঠিক সে কারণে হাতিয়া নামকরণ হওয়ার পেছনে তারা গ্রহণযোগ্য যুক্তি উপস্থাপন করেছেন বস্তুত ধারণাটি অবিশ্বাস্য  মনে হয় না প্রবাদ অনুযায়ীহা-ইতিহ্শব্দ হতেহাতিয়ানামের উৎপত্তি হয়েছেহা-ইতিহ‘পর্তুগীজ শব্দ, এর অর্থ

হাতিয়ার কাজির পাড়া সৈকত
অগভীর সমুদ্র বা নদী তলস্থ উচুঁ-ভূমি জনশ্রুতি, বিশ্বখ্যাত পর্যটক টলেমি ১৫০ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগিজ নাবিকদের নিয়ে বায়ুচালিত জাহাজে করে হাতিয়া উপকূল দিয়ে যাওয়ার সময় বর্তমান হাতিয়া নামে পরিচিত  দ্বীপ-ভূখন্ডটির প্রতি দৃষ্টি পড়ে দূরবীনের লেন্সে  আভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য এবং সম্পদের সংযোজনা টলেমিকে দ্বীপের প্রতি ভীষণ আগ্রহী করে তোলে তিনি জাহজের নাবিকদেরকে   ভূখণ্ডটির দিকে জাহাজ ঘুরানোর নির্দেশ দেন ওখানে উঠার জন্য গ্রীক পর্যটক পর্তুগীজ ক্যাপ্টেন  জাহাজের মুখ দ্বীপের দিকে ঘুরায়, স্বাভাবিক গতিতে এগিয়ে যায় জাহাজ জাহাজের গতির বিপরীতে ভূখন্ডটি ক্রমশঃ স্পষ্ট হয়ে উঠে অধীর আগ্রহে দ্বীপের দিকে তাকিয়ে জাহাজের সবাই, দ্বীপের লোকেরাও অনুরূপ আগ্রহে অধীর তো মাত্র আর অল্প, এক্ষুণি লাগবে দ্বীপের গায়ে  কিন্তু না, কিছুদূর আসতে না আসতেই জাহাজটি দ্বীপ উপকূলবর্তী  অগভীর জলের ডুবো চরে আটকে যায় মহা বিরক্ত নিয়ে চীৎকার দিয়ে উঠেন জাহাজের ক্যাপ্টেনহা-ইতিহ্ জাহাজঘাটা লোকারণ্য, তারা জাহাজটিকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত ছিল, কিন্তু থেমে যাওয়াতে দ্বীপ বাসীরাও হতাশ হয়ক্যাপ্টেনের সাথে সুর মিলিয়ে একসাথে জাহাজের অন্যান্য নাবিকেরাও চীৎকার দিয়ে উঠেহা-ইতিহ্ দ্বীপে অপেক্ষমান লোকজনের কানেও এসে লাগে প্রচন্ড নিনাদহা-ইতিহ্তারাও আগন্তুক অতিথিদের সমর্থনে চীৎকার দিয়ে উল্লাস জানায়,হা-ইতিহ্ জাহাজটি তিনদিন আটকে ছিল, দ্বীপবাসীরা নৌকায় করে গিয়ে তাদের ভাষাতেই সম্বর্ধনা দিয়ে আসেহা-ইতিহ টলেমি লিখে নেন তাঁর ডায়েরীতেদ্বীপের নাম হা-ইতিহ্ যা  ক্রমান্বয়ে হাতিয়ায় পরিণত হয়  
জনবসতি শুরুর প্রারম্ভে খ্রিস্টপূর্ব সময়ে মহাভারত যুগের পর কয়েক দশক পর্যন্ত হাতিয়া দ্বীপ সাগর দ্বীপ বা সাগরদীহি নামে লোকারণ্যে পরিচিত ছিল অনেকের কাছে পুরো দ্বীপটি তখনসাগর দ্বীপ’ (অধুনালুপ্ত সাগরদী) এবং একটি অংশ রামচরণ নামে পরিচিত ছিল ক্রমশঃ দ্বীপটির জনসংখ্যা বাড়তে থাকে জনসংখ্যা বাড়লেও তখন পর্যন্ত সাগরদ্বীপেকোনো ধরণের যানবাহন ছিল না হাটা ব্যতিরেকে এলাকাবাসীর স্থানান্তরের বা যোগাযোগের অন্যকোন উপায় ছিল না হাঁটিয়া ঁহাটিয়া প্রয়োজনীয় যোগাযোগ সম্পন্ন করতে হতো হাঁটতে হাঁটতে দ্বীপে নবাগতদের অনভ্যস্ত পায়ে ধরে যেত ব্যথা ব্যথাতুর পায়ে মূল ভূখন্ডে গিয়ে আক্ষেপ করত- দ্বীপবাসীর জন্য কোথায় গিয়েছিলেন বা কোথায় হতে আসছেনএমন  প্রশ্ন কেউ করলে কিংবা জানতে চাইলে সবাই উপহাস স্বরূপ বলত, “মোরা  ‘হাটিয়াহতে এসেছি এভাবেসাগরদ্বীপনামে পরিচিত সামুদ্রিক ভূ-ডলফিনটিহাটিয়া’  নামে পরিচিতি লাভ করে যা ক্রমান্বয়ে হাতিয়ায় পরিবর্তিত হয়েহাতিয়ানাম ধারণ করে 
অনেকের ধারণা নতুন বসতি স্থাপনকালে হাতিয়া দ্বীপের আকৃতি অনেকটা হাতির ক্ষুরের মত ছিল বলে দ্বীপটিকে তৎকালীন বাসিন্দা কিরাতরাহাতির দ্বীপবলত পরবর্তীকালে হাতির দ্বীপ বিভিন্ন সময় পরিসংযোজিত হয়ে হাতিয়া নাম ধারণ করে অনেকে মনে করেন তৎকালে হাতিয়া দ্বীপটিকে নৌ-পথে আসার সময় দূর হতে অনেকটা হাতির ক্ষুরের মত দেখাত তাই লোক মুখে এটা ক্রমান্বয়ে হাতিয়া নামে পরিচিত হয়ে উঠেআবার কেউ কেউ বলে থাকেন যে, “হাতি-অ্যায়াশব্দ  হাতিয়া নামকরণের উৎস প্রাগৈতিহাসিক আমলে একটি মরা হাতি ভেসে এসে হাতিয়া উপকূলে আটকে গিয়েছিল দ্বীপবাসী
কিরাতরা হাতিকে দেবতা জ্ঞানে পূজা করত মরা হাতিটাকে সসম্মানে অপসারণের অনেক চেষ্টা করেও কিরাতরা ব্যর্থ হয় পাপ এবং  অভিশাপের ভয়ে হাতিটাকে কেটে বা রশি দিয়ে বেঁধে অপসারণের চেষ্টা করা হতে বিরত থাকে হোক না মরা, তবুতো হাতি, পূজ্য দেবতা দলে দলে লোক এসে বিশালকার পশু দেবতা হাতিকে পূজো দিতে থাকে সাড়া পড়ে যায় পুরো দ্বীপে লোকজনহাতি-আয়াচীৎকারে চারিদিক মাতোয়ারা করে ছুটে চলে নদীপানে, যেখানে হাতি শুয়ে চিৎপটাং এভাবেহাতি-আয়াশব্দটি সংযুক্ত হয়েহাতিয়ায়পরিণত হয় এবং সেখান হতে দ্বীপটির নাম হাতিয়া হয়েছে বলে অনেকের অভিমত 
ওবায়দুল করিম নসরতের বর্নণা অনুসারে- সাগর উপকূলবর্তী দ্বীপাঞ্চলটি সুদীর্ঘকাল জঙ্গলাকীর্ণ মানববসতিহীন অবস্থায় থাকায় দ্বীপটিতে বণ্য প্রাণীর নিবিড় রাজত্ব কায়েম ছিল বাঘ, ভালুক, হরিণ, শুকর, বানর ইত্যাদি অসংখ্য বণ্য প্রাণীর সাথে সাথে দ্বীপটিতে হাতিও আগমন করেছিল বাক্যের উর্দু পরিভাষাহাতি বি আয়া হাতি বি আয়াশব্দের অপভ্রংশ হতেহাতিয়ানামের উৎপত্তি হয়েছে অনেকের অভিমত যে, হাতিয়া-সন্দ্বীপের শাসক বিখ্যাত দিলাল রাজার হাতি হতে হাতিয়া নামের উৎপত্তি তাদের মতে, দিলাল রাজার বিখ্যাত হাতিটি একদিন উপকূলে নদীর কাদায় আটকে যায় ছড়িয়ে পড়ে খবর, লোকজন এসে দেখে হাতির পা কাদায় আটকে আছে হাতির পা-আটকা এবং তদপরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে হাতিয়া নাম প্রবর্তিত তবে কাহিনীটি হাতিয়ার বয়স বিবেচনায় নিছক রূপকথা ছাড়া অন্য কিছু মনে করার কোন অবকাশ নেই  ১৬১৬ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দিলাল রাজা হাতিয়া শাসন করেছিলেন কিন্তু হাতিয়ার বয়স ছয় হাজার বছর হতে তিন হাজার বছর যেখানে খ্রিস্টপূর্ব দুই হাজার অব্দে হাতিয়া নাম সৃষ্টির প্রবাদ আছে এবং ১৫০ খ্রিস্টাব্দে টলেমির বিবরণীতেহাতিয়া’ নাম উল্লেখ আছে সেখানে দিলাল রাজার আমলে হাতিয়া নামকরণ প্রবাদটা নিছক গল্প মনে করেন অনেকে। 
এক সময় হাতিয়া এবং সন্দ্বীপে জলদস্যুদের সাংঘাতিক দৌরাত্ব্য ছিল জলদস্যুদের অত্যচার হতে দ্বীপবাসীকে রক্ষার জন্য বাংলার তৎকালীন শাসক শের শাহ হাতিয়াল খাঁ নামক একজন সেনাপতির নেতৃত্বে একদল সৈন্য প্রেরণ করেছিলেন হাতিয়াল খাঁ হাতিয়া আসছেন জানতে পেরে জলদস্যুরা নৌকাযোগে পালিয়ে বর্তমান হাতিয়া দ্বীপে চলে আসে বর্তমান হরণী এলাকার জঙ্গলে তারা আত্মগোপন করে সদলবলে সেনাপতি হাতিয়াল খাঁ-ও জলদস্যুদের ধাওয়া করে হাতিয়া চলে আসেন  অল্পদিনের মধ্যে হাতিয়াল খাঁ সাফল্যের সাথে তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে দ্বীপবাসীর মন জয়ে সমর্থ হন দ্বীপকে দস্যুমুক্ত করায় হাতিয়াল খাঁ পুরো এলাকায় অবিসংবাদিত সাহসী ব্যক্তি হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে হাতিয়াল খাঁর নামানুসারে তাঁর কতিপয় অনুসারী দ্বীপটির নাম  ‘হাতিয়াল দ্বীপরাখেন পরবর্তীকালে যাহাতিয়ালদ্বীপ এবং পরেহাতিয়ালশব্দেরবিভিন্ন বিবর্তনের মাধমে দ্বীপের মত বিচিছন্ন হয়েহাতিয়াধারণ করে  
আরেকটি জনপ্রিয় প্রবাদ এ যে, বিদেশীদের মধ্যে সর্বপ্রথম পোলান্ডের আর্যরাই খ্রিস্টপূর্ব ৮শ কিংবা অব্দে হাতিয়া আসে একজন আর্য দ্বীপে উঠার জন্য নৌ-ঘাটে পানসী ভেড়ায় দ্বীপে লোকজন তেমন একটা বেশি ছিল না যারা ছিল তারা নিজেদের কাজ নিয়েই অধিকাংশ সময় ব্যস্ত থাকত পর্যটকের পানসী যখন জাহাজঘাটে লাগে তখন জনৈক দ্বীপবাসী মূল ভূখন্ডে যাবার জন্য দ্বীপের নৌ-ঘাটে অপেক্ষা করছিল আর্য ভদ্রলোক দ্বীপে উঠে সর্বপ্রথম লোকটির সাক্ষাৎ পায় পর্যটক সাগরদ্বীপের অনার্যদের ভাষা জানতেন না তিনি স্থানীয় ভদ্রলোকটির কাছে আর্য ভাষায় দ্বীপটির নাম জানতে
চাইলেন কিন্তু বেচারা দ্বীপবাসী পর্যটকের কোনো কথাই বুঝতে পারছিল না কিন্তু বুঝে না তো কী, তা অন্যকে জানতে দেবে কেন? বুঝেনি এটা তিনি ভিনদেশী ভদ্রলোককে বুঝতে দিতে রাজী ছিলেন না, হয়ত সত্যই মনে করেছিলেন -‘আমি কিভাবে এসেছি  ভদ্রলোক তা জানতে চেয়েছে’ সে হেঁটেই এসেছে আর্য ভদ্রলোক তার দিকে তাকিয়ে আবার  একই প্রশ্ন রাখেনএবার দেরী না করে সাগরদ্বীপের অনার্য কিরাত গোষ্ঠীভূক্ত ভদ্রলোক, উত্তর দেয়, ‘হাঁটিয়া পোলান্ডের আর্য ভদ্রলোক মনে করল  এটাই দ্বীপটির নাম তিনি তাঁর নোট বুকে লিখে রাখলেন, দ্বীপটির নামহাটিয়া তখন হতে দ্বীপটি ইংরেজীতেহাটিয়ানামে পরিচিত হয়ে উঠে যা বাংলায় কিছুটাহাতিয়ারূপে উচচারিত হয়  
আরেকটি প্রাচীন প্রবাদ যে, পান্ডববীর ভীম পূর্ব দেশীয় নৃপতিদের বিরুদ্ধে এক বিশাল অভিযান পরিচালনা করেছিলেন  পূর্বদেশীয় অনার্য নৃপতিরা পরাজিত হয়ে হাতিয়ায় আশ্রয় গ্রহণ করে এবং সম্মিলিত হয়ে ভীমের বিরুদ্ধে প্রতি আক্রমণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে তারা সাগরদ্বীপে প্রচুর পরিমাণ হাতিয়ার এনে ভীমের বিরুদ্ধে লড়ার প্রস্তুতি শুরু করে হাতিয়া ব্যতীত পুরো অঞ্চল তখন ভীমের দখলে চলে গিয়েছিল অনার্য নৃপতিদল
মহামান্য রাষ্ট্রপতির সঙ্গে হাতিয়ার ইতিহাস এর লেখক
হাতিয়াকে আশ্রয় করে ভীম-বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা করতে থাকে বর্তমান হাতিয়ায় একটি গভীর অরণ্য এলাকার উত্তর-পশ্চিম কোণে অনার্য নৃপতিরা স্বল্প সময়েহাতিয়ার তৈরীরএকটা  কারখানা মওজুদগার গড়ে তুলে হাতিয়ার তৈরীর কারখানা হতে আলোচ্য দ্বীপটিহাতিয়ানামে পরিচিত হয় বলে অনেকে মনে করেন 
আজ হতে ছয় হাজার বছর পূর্বে দ্বীপ সৃষ্টির পরবর্তী দুই হাজার বছর পর্যন্ত আলোচ্য দ্বীপটি জনবসতি শুণ্য ছিল বিশাল বৃক্ষ, গভীর অরণ্য এবং অগনিত জন্তুই ছিল দ্বীপটির হর্তা-কর্তা বেদ যুগের সময় দ্বীপে অন্যান্য বন্য জন্তু ছাড়াও প্রচুর হাতি ছিল বলে প্রবাদ আছে অন্যান্য এলাকা হতে লোকজন এসে দ্বীপ হতে হাতি ধরে নিয়ে যেত জনশ্রুতিলোকবসতিহীন দুই হাজার বছরের হাতিয়ায় এত বেশী এবং বড় হাতি ছিল যে, হাতির জন্য দ্বীপটির সুনাম মনুষ্য বসতির পূর্বেই চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল হাতির প্রাচুর্য-পরিমাণ হতে দ্বীপটির নাম হাতিয়া হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন প্রবাদটির সাথে ওবায়দুল করিম নসরত বর্ণিত প্রবাদটির যথেষ্ট মিল লক্ষণীয়

সূত্র : তিলোত্তমা হাতিয়া : ইতিহাস ও ঐতিহ্য, ড. মোহামম্মদ আমীন।