স্যমন্তক / ড. সাহিদা সুলতানা অনি
স্যমন্তক কেন পড়বেন
ড. মোহাম্মদ আমীনের লেখা স্যমন্তক উপন্যাসের কাহিনি পৌরাণিক স্যমন্তকের কাহিনির চেয়েও আকর্ষণীয়, হৃদয়গ্রাহী ও মুগ্ধকর। বাস্তবতা আর জীবনের উত্তম বিষয় থেকে তিল তিল উত্তম বিষয়সমূহ নিয়ে এ তিলোত্তম উপন্যাসটি রচিত। পৌরাণিক স্যমন্তক ছিল মহামূল্যবান মণি। যে মণির স্পর্শে স্বর্ণে পরিণত করা যেত সাধারণ কিছু বস্তুকে। তবে পরশ পাথরের সঙ্গে স্যমন্তকের তফাৎ আছে। যে কেউ পরশ পাথর অধিকারে রাখতে পারতেন এবং এর স্পর্শে যে কোনো কিছুকে স্বর্ণে পরিণত করা যেত। তবে স্যমন্তক এমন একটি মণি, যা অধিকারে রাখতে হলে তার কিছু গুণ থাকা আবশ্যক ছিল। শুধু তাই নয়, কোনো বস্তুকে স্যমন্তকের স্পর্শে স্বর্ণে পরিণত করতে হলে ওই বস্তুটিরও কিছু যোগ্যতা থাকতে হতো।
পৌরাণিক স্যমন্তক একটি মহামূল্যবান মণি। আমাদের স্যমন্তক মণি নয়, মহামূল্যবান একজন মানুষ।উপন্যাসের নায়ক। যার পরশে অতি সাধারণ মানুষও পরিণত হয়েছে মূল্যবান মানুষে। পৌরাণিক স্যমন্তক ছিল সূর্যদেবের কণ্ঠহারের রত্ন | বিষ্ণু পুরাণ এবং মহাভারত অনুযায়ী এই রত্ন সোনার চেয়ে ৮ গুণ বেশি উজ্জ্বল ছিল | পৌরাণিক স্যমন্তকের আকর্ষণ ছিল উজ্জ্বলতা।আমাদের স্যমন্তকের আকর্ষণ ভালোবাসা।যা স্বর্ণের চেয়ে কোটি গুণ অধিক উজ্জ্বল। ভালোবাসা মানুষকে স্যমন্তকে পরিণত করতে পারে। কীভাবে একজন সাধারণ মানুষ স্যমন্তকের মতো মহামূল্যবান হয়ে উঠতে পারে এবং কীভাবে অন্যকেও অমন মূল্যবান করে তুলতে পারে - তা জানার জন্য উপন্যাসটি একবার হলেও পড়া প্রয়োজন।
স্যমন্তক মণি ছিল সূর্যদেবের কণ্ঠহারের রত্ন | বিষ্ণু পুরাণ এবং মহাভারত অনুযায়ী এই রত্ন সোনার চেয়ে ৮ গুণ
বেশি উজ্জ্বল ছিল | সূর্যদেব খুশি হয়ে স্যমন্তক মণি উপহার দেন তাঁর পরম ভক্ত দ্বারকার সত্রাজিৎকে | কৃষ্ণ তাঁকে অনুরোধ করেন ওই মণি রাজা উগ্রসেনকে দিয়ে দেওয়ার জন্য | কিন্তু তাঁর কথা উপেক্ষা করেন সত্রাজিৎ | তিনি ওই রত্ন দেন তাঁর ভাই প্রসেনকে |
একদিন প্রসেন ওটি কণ্ঠহারে পরে গেলেন শিকারে | গাছে বসে এক সিংহকে তাক করেছেন তিনি | গলায় ঝুলছে দুর্লভ মণি | হঠাৎ হিসহিস শব্দ শুনে উপরে তাকান প্রসেন | চমকে দেখেন‚ মাথার উপরে দুলছে বিষাক্ত সাপ |উপরে সাপ‚ নিচে সিংহ‚ কী করবেন বুঝতে না পেরে লাফ দিলেন প্রসেন | যে কণ্ঠহারে ছিল স্যমন্তক‚ সেটি গাছের ডালে জড়িয়ে গলায় ফাঁস লেগে মৃত্যু হল প্রসেনের | জমিতে ছিটকে পড়ল স্যমন্তক |
উজ্জ্বলতা দেখে সিংহ সেটিকে নিয়ে গেল মুখে করে | কিন্তু পথে এসে পড়ল ভাল্লুকরাজ জাম্বুবান | তিনি সিংহকে মেরে হস্তগত করলেন মণি |এদিকে প্রসেনকে না পেয়ে সত্রাজিৎ হাজির কৃষ্ণের কাছে | তিনি সরাসরি দোষারোপ করলেন‚ মণির লোভে প্রসেনকে হত্যা করেছেন কৃষ্ণ নিজে | অতঃপর অপরাধ খণ্ডাতে কৃষ্ণ নিজে গেলেন প্রসেনের সন্ধানে |
গভীর বনে গিয়ে কৃষ্ণ দেখতে পেলেন প্রসেনের নিথর দেহ | কিন্তু উধাও স্যমন্তক | কৃষ্ণ জমিতে সিংহের পদচিহ্ন অনুসরণ করে এগোলেন | দেখলেন পড়ে আছে পশুরাজের দেহ | বুঝলেন তার সঙ্গে অন্য কোনও পশুর ধস্তাধস্তি হয়েছে |
এবার নতুন করে বনভূমির রেখা অনুসরণ করে এগোলেন কৃষ্ণ | গিয়ে পৌঁছলেন জাম্বুবানের গুহামুখে | গুহামুখে বেরিয়ে আসা উজ্জ্বল ছটা দেখে বুঝলেন গুহার ভিতরেই আছে স্যমন্তক | সঙ্গীদের বাইরে রেখে একাই প্রবেশ করলেন কৃষ্ণ | দেখলেন‚ রত্ন নিয়ে খেলছে জাম্বুবানের পুত্র !
সেই মুহূর্তে কৃষ্ণের সামনে এলেন জাম্বুবান | দুজনের ভিতর যুদ্ধ হল টানা ২৮ দিন ধরে | অবশেষে আত্মসমর্পণ করলেন ভাল্লুকরাজ | কৃষ্ণের হাতে ফিরিয়ে দিলেন স্যমন্তক | সেইসঙ্গে নিজের মেয়ে জাম্ববতীকে | বিবাহ সম্পন্ন হল কৃষ্ণ-জাম্ববতীর |মণি এবং নববধূকে নিয়ে দ্বারকায় ফিরলেন কৃষ্ণ | ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমা চাইলেন সত্রাজিৎ | অনুতপ্ত হয়ে কৃষ্ণকে দিতে চাইলেন স্যমন্তক মণিসহ নিজের তিন মেয়ে সত্যভামা‚ ব্রতীনি এবং প্রস্ববিনীকে |
সত্রাজিৎ কন্যাদের পানি গ্রহণ করলেন শ্রীকৃষ্ণ | কিন্তু নিলেন না স্যমন্তক | সেটি রয়ে গেল সত্রাজিতের কাছেই |এদিক সত্যভামার প্রতি অনুরক্ত ছিলেন দ্বারকার শতধন্ব‚ অক্রূর এবং কৃতবর্মা | তাঁরা সত্রাজিতের এই আচরণ মেনে নিতে পারেননি | একদিন‚ কৃষ্ণ-বলরাম গেছেন হস্তিনাপুরে | ঘুমন্ত সত্রাজিতকে হত্যা করে স্যমন্তক মণি চুরি করলেন শতধন্ব | পরে আতঙ্কিত হয়ে ওই রত্ন অক্রূরের কাছে রেখে পালিয়ে যান তিনি |
সব জানতে পেরে দ্বারকায় ফিরে আসেন কৃষ্ণ-বলরাম | দুজনে শতধন্বের সন্ধানে গেলেন | মিথিলার কাছে কৃষ্ণের হাতে প্রাণ হারালেন শতধন্ব | আরও একবার বার কৃষ্ণ স্যমন্তক মণি নিয়ে ফিরলেন দ্বারকায় | তিনি এ বার স্যমন্তক মণি দিয়ে দিলেন অক্রূরকে | একটা শর্তে‚ যেন এই মণি কোনওদিন দ্বারকার বাইরে না যায় | এইভাবে স্যমন্তক ফিরে এল দ্বারকায় | একইসঙ্গে কৃষ্ণ চারজন দার পরিগ্রহ করলেন |
কৃষ্ণের প্রয়াণ বা দ্বারকার পতনের পরে এই মণির কী হয়েছিল তা বলা হয়নি মহাকাব্য বা পুরাণে | অনেকে মনে করেন ‚ কোহিনূর হিরেই হল পুরাণের স্যমন্তক | যদিও এই মত অগ্রাহ্য করেন বেশিরভাগ পণ্ডিত এবং রত্ন বিশেষজ্ঞ | তাঁরা মনে করেন এই রত্ন ছিল আসলে একটি দুর্লভ চুনী ।
No comments:
Post a Comment