Thursday 17 September 2015

দাপ্তরিক প্রমিত বাংলা বানান ড. মোহাম্মদ আমীনের লেখা একটি অসাধারণ গ্রন্থ / হায়াৎ মামুদ

 দাপ্তরিক প্রমিত বাংলা বানান

মাতৃভাষা মায়ের মতো নির্ঝর ভালবাসায় নিবিড় এবং জীবনের মতো মায়াময় চিরন্তনতায় গভীর ও অনিবার্য এক প্রত্যয়। এর প্রমুগ্ধ  সোহাগের অনুপম বন্দনা মানুষের উৎকৃষ্ট প্রকাশ-মাধ্যম। তাই প্রত্যেকের কাছে মাতৃভাষা অতি পবিত্র। জন্ম হতে মৃত্যু পর্যন্ত মাতৃভাষা আমাদের আশা-আকাক্সক্ষা আর সাংস্কৃতিক
জীবনের মূল্যবোধকে কথামৃতের মৃণ্ময় মাধুর্য্যে উচ্ছ্বল করে রাখে। মাতৃভাষা জীবনবোধের চিরন্তন অনুভূতিকে মায়ের লালিত্যে প্রকৃতির মতো বিস্তৃত স্নেহ আর আকাশের মতো চঞ্চল কলহাস্যের অপূর্ব ব্যঞ্জনায় বাঙ্ময় করে তোলে। এজন্য একজন আদর্শ মানুষের কাছে অন্য যেকোনো ভাষার চেয়ে নিজের মাতৃভাষা পরম পবিত্র আমানত হিসাবে স্বীকৃত। এ আমানতকে যে জাতি যত মর্যাদার সঙ্গে বরণ করতে পারে, সে জাতি তত মর্যাদাবান হওয়ার উপাদানে বিভূষিত হয়।

বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। এ ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য বাঙালি জাতি সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছে। জীবন দিয়েছে অকাতরে। এ ভাষার সূত্র ধরে আমরা পেয়েছি স্বাধীন জাতি এবং অখ- ভূমি। এখন প্রাত্যহিক কর্মকা-ে প্রমিত বাংলা প্রয়োগে আমাদের অজ্ঞতা, অবহেলা ও যথেচ্ছাচার সে পরম ত্যাগকে রীতিমতো হাস্যকর করে তোলেছে। যে জাতি ভাষার জন্য জীবন দিতে পারে, সে জাতি ভাষাকে শুদ্ধভাবে আয়ত্ত্ব করার জন্য সামান্য শ্রম দিতে কুণ্ঠিত হচ্ছে - এমন আত্মপ্রবঞ্চক আচরণ পৃথিবীর আর কোনো জাতির মধ্যে লক্ষ করা যায় না।

শুদ্ধতা ভাষার প্রাণ এবং প্রমিত প্রয়োগ তার দেহাবয়ব স্বরূপ। একটি ছাড়া অন্যটি অর্থহীন। তাই একটি সজীব ভাষার জন্য শুদ্ধতা, আদর্শমান ও প্রমিত প্রয়োগ অত্যাবশ্যক। শুদ্ধতা ও আদর্শমান বজায় রাখা ছাড়া মাতৃভাষার সজীবতা ও মর্যাদা রক্ষার অন্য কোনো উপায় নেই। ব্যক্তি  মাতৃভাষার মাধ্যমে নিজের অভিব্যক্তিকে যত স্বাচ্ছন্দ্যে নিবেদন করতে পারে, তা অন্যকোনো ভাষা দিয়ে সম্ভব নয়। তাই প্রত্যেকের কাছে মাতৃভাষা তার নিজের অস্তিত্বের অলঙ্ঘনীয় স্মারক।

শিক্ষিত ও অশিক্ষিতের মধ্যে যে পার্থক্য, শুদ্ধ আর অশুদ্ধের মধ্যেও সে পার্থক্য। যিনি মাতৃভাষার শুদ্ধতায় অমনোযোগী, তিনি যেন নিজের মায়ের প্রতি অমনোযোগী। যিনি মাতৃভাষার প্রতি অবহেলা করেন, তিনি যেন মায়ের প্রতি অবহেলা করেন। মাতৃভাষার প্রতি স্বেচ্ছাচার নিজের মায়ের প্রতি স্বেচ্ছাচারের নামান্তর। এমন কুপুত্র কখনও কী আদর্শ হতে পারে? যে জাতি এমন কুপুত্র ধারণ করে সে জাতি কখনও আদর্শ জাতি হতে পারে না। ভাষাপ্রেম দেশপ্রেমের অন্যতম পূর্বশর্ত। যা আমরা ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে প্রমাণ করেছি। কিন্তু এখন?

ইদানীং বাঙালি জীবনের প্রাত্যহিক কর্মকা-ে মাতৃভাষার প্রতি অবহেলা ও স্বেচ্ছাচারিতা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে। এমনকি উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিবর্গের দ্বারা বিন্যস্ত দাপ্তরিক কর্মকা-েও বাংলা ভাষার প্রমিত প্রয়োগে লজ্জাকর অবহেলা, অসহনীয় স্বেচ্ছাচারিতা এবং অবিশ্বাস্য অজ্ঞতা লক্ষণীয়। এমন আচরণ জাতীয় জীবনের মূল উৎসধার হিসাবে চিহ্নিত সাংস্কৃতিক পরিম-লের বিহ্বল নান্দনিকতায় কুঠারাঘাত বললেও অত্যুক্তি হয় না। এটি শুধু লজ্জা নয়, বলা যায় আমাদের চরম লজ্জা।

এমন লজ্জা হতে উত্তরণের প্রয়াস হিসাবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে দাপ্তরিক কর্মকা-ে প্রমিত বাংলার কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করার জন্য বাংলা একাডেমি প্রমিত বানান বিধিার আলোকে বিবিধ নির্দেশনা প্রদান করেছে। এ নির্দেশনার আলোকে ড. মোহাম্মদ আমীন দীর্ঘ গবেষণালব্ধ অভিজ্ঞানের সঙ্গে প্রায়োগিক অভিজ্ঞতার সমন্বয় ঘটিয়ে ‘দাপ্তরিক প্রমিত বাংলা বানান’ গ্রন্থটি রচনা করেছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হতে শুরু করে সরকারি, বেসরকারি নানা দপ্তরে প্রমিত বাংলা প্রয়োগে যে সীমাবদ্ধতা দেখা যায়, তা দূরীভূত করার জন্য এ গ্রন্থটি কার্যকর ভূমিকা রাখবে। এমন একটি সময়োপযোগী গ্রন্থ রচনার জন্য সুহৃদ ড. মোহাম্মদ আমীনকে ধন্যবাদ জানাই। আমি গ্রন্থটির বহুলপ্রচার কামনা করি।

No comments:

Post a Comment