Wednesday 20 December 2017

ভালোবাসা শুধুই ভালোবাসা / প্রমিত দাস লাবণী

ভালোবাসা শুধুই ভালোবাসা

ড. মোহাম্মদ আমীনের লেখা একটি গল্পগ্রন্থ। গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার আগে এর তিনটি গল্পে ফেসবুকে প্রকাশিত হয়। তিনটি গল্পই ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে যায়। স্যার আমাকে বিয়ে করুন নামের গল্পটি দিয়ে অনেক চ্যানেল ভিডিও পর্যন্ত তৈরি করে। অর্থনীতির অধ্যাপক সেলসম্যান এবং বউ’ শিরোনামের গল্পটি ফেসবুকে প্রকাশিত হওয়ার বোদ্ধামহলে সাড়া পড়ে যায়। বিদেশি নাম দেখে অনেকের মনে হতে পারে এটি কোনো গল্পের বঙ্গানুবাদ। লেখকের ভাষায়, “এটি কোনো অনুবাদ নয়, আমেরিকায় থাকাকালীন বেস্ট বাই চেইন শপে বাজার করতে গিয়ে গল্পটির প্লট আমার মাথায় আসে।” তাই চরিত্রের নাম বিদেশি। নিচে পাঠকদের জন্য গল্পটি লেখকের অনুমতি নিয়ে প্রকাশ করা হলো। অসাধারণ কিছু গল্প নিয়ে সজ্জিত এই বইটি পড়লে আপনার এবং আপনার উত্তরসুরী- সবার বিবেক আনন্দ আর ঔদার্যে বিকশিত হয়ে উঠবে।  এটি আমি নিশ্চিত বলতে পারি। এ গ্রন্থের আর একটি গল্পের লিংক দিলাম।(https://www.facebook.com/mohammed.amin.714655/posts/1642520929138028?pnref=story)। বইটি পাবেন আগামী (২০১৮) অমর একুশে গ্রন্থমেলায় পুথিনিলয়-এর স্টলে। দাম মাত্র ১২০ টাকা।  গ্রন্থটির প্রচ্ছদ করেছেন মামুন হোসাইন। 

অর্থনীতির অধ্যাপক সেলসম্যান এবং বউ 

ভদ্রলোক দোকানে ঢুকে সেলসম্যানকে বললেন : প্লাস্টিকের একটা টুল নেব। দুই ডলারের বেশি যেন না
হয়। কোনোভাবে আমি দুই ডলারের বেশি খরচ করব না।
সেলসম্যান বলল : আমার নাম কুপার। আমাদের বেস্ট বাই চেইন শপে পৃথিবীর সবদেশের সব ভালো টুল পাবেন। আরামদায়ক, টেকসই এবং আকর্ষণীয় কিন্তু দাম হাতের নাগালে। তিন ডলার খরচ করলে সেরাটা পেয়ে যাবেন। টুল ছাড়া আর কিছু নেবেন না স্যার?
ক্রেতা বললেন : ধন্যবাদ। আমি মোস আর্নেস। ফিলাডেলফিয়া ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক। চিন্তাভাবনা করে খরচ করি। আমাকে কোনো সেলসম্যান গলাতে পারেনি। আপনিও পারবেন না।
: দেখলেই বোঝা যায় আপনি প্রবল ব্যক্তিত্ববান। অপ্রয়োজনীয় সওদা ভালো নয় স্যার। আমি সেলসম্যান হলেও কখনো ক্রেতাকে অনাবশ্যক কিছু কিনতে উদ্বুদ্ধ করি না। নিজের লাভের জন্য অন্যের ক্ষতি করা অপরাধ।
মিস্টার আর্নেস একটা টুল পছন্দ করলেন। সেলসম্যান টুলটি হাতে নিয়ে বললেন : অপূর্ব। অপূর্ব আপনার পছন্দ। এমন সুন্দর টুল কোথায় ব্যবহার করবেন স্যার?
: লেকের পাশে বসে প্রকৃতি দেখব। প্রকৃতি আমার প্রেম।
: প্রকৃতিকে তারাই এভাবে উপভোগ করেন, যারা প্রকৃতির মতো সুন্দর। কিন্তু স্যার, একটা জিনিস বেশিক্ষণ দেখলে ভালো-লাগাটা কমে যায়। এই ধরুন আমার গার্লফ্রেন্ড, প্রথম প্রথম কী যে ভালো লাগত! কণ্ঠ শুনলেই শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে উঠত। এখন গায়ে আছড়ে পড়লেও রোমাঞ্চ আসে না। প্রকৃতির ক্ষেত্রেও এমন ঘটতে পারে।
: কী করতে পারি?
: টুলে বসে মাছ ধরবেন। ফাঁকে ফাঁকে প্রকৃতি দেখবেন। চনাচুর খাবেন, সিগারেট টানবেন, বিয়ার খাবেন, ক্লান্তি এলে বিশ্রাম নেবেন। বিশ্রাম স্বপ্নের বাগান। খুব ভালো লাগবে। কিছু বড়শি দিই স্যার?
: দাও।
বড়শি দিতে দিতে সেলসম্যান বলল : খুব ভালো বড়শি দিলাম। কিন্তু স্যার বড়শি কোথায় বাঁধবেন? আমাদের খুব ভালে সুতো এবং অত্যাধুনিক ছিপ আছে। পছন্দ হবে আপনার। এক সেট দিয়ে দিই?
: দাও।
সেলসম্যান ঝুড়িতে সুতো ও ছিপ রাখতে রাখতে বললেন : অনেকক্ষণ বসে থাকতে হবে। মাংসে ব্যথা হয়ে যেতে পারে। আমাদের দোকানে ভালো কিন্তু সস্তা দামের গদি আছে। বেশ তুলতুলে। আরামের কোনো বিকল্প নেই।
: ঠিক বলেছ। একটা গদি লাগবেই। আমি অফিসের চেয়ারেও গদি ব্যবহার করি।
ধুসর রঙের একটা গদি নামিয়ে সেলসম্যান বলল : স্যার, প্রকৃতি রূপসী মেয়ের মতোই আকর্ষণীয় কিন্তু সেকেন্ডেরও বিশ্বাস নেই। খানিক রোদ, খানিক বৃষ্টি. খানিক ঝড়, খানিক বরফ। হঠাৎ যদি কড়া রোদ উঠে কিংবা ভারী বৃষ্টি হয় তখন কী করবেন?
: তাই তো! কী করব?
: একটা ছাতা এবং একটা সানগ্লাস নিয়ে যান। আমি কী স্যার ভুল বলেছি?
: না। আসলেই প্রয়োজন। দাও এবং কত দাম হলো দেখ। এবার যাব।
: যাবেন স্যার? ছাতার সঙ্গে দুই প্যাকেট চনাচুর, তিন ডজন পানির বোতল, এক ডজন বিয়ার, একটা
ড. মোহাম্মদ আমীন
ফ্লাস্ক, চার সেট কাপ-পিরিস, চারটা চামচ, দুই ব্যাগ চা, আধ কেজি চিনি দিলাম।এগুলি ছাড়া অ্যাংলিং জমে না। আর একটা কথা, এখন না বললে পরে আমার উপর মাইন্ড করবেন। ছোটো টুলটা দিয়ে হবে না। ওটায় চায়ের সরঞ্জাম রাখবেন। আর একটা বড়ো টুল দিলাম। ভারতীয় ঋষির মতো আরাম করে বসতে পারবেন।
: ঠিক আছে। দিয়েছ যখন কী আর করা। তবে অতিরিক্ত কিছু নেব না। আমি অর্থনীতির প্রফেসর।
: স্যার, ধরুন, আপনার বড়শি মাছে টান দিল। বড়ো মাছ। আপনি উত্তেজিত। এসময় হঠাৎ কোনো মশা বা পোকা কামড় দিল, কী হবে? আমি হলে স্যার, একটা ইনসেক্টিসাইড নিতাম।
: সামান্য ইনসেক্টিসাইডের জন্য এত বড়ো মাছটা চলে যাবে। দাও একটা। কিন্তু মাছ বড়ো না ছোটো এটা আমি কীভাবে বুঝব?
: একটা দূরবীন নিয়ে যান। রাতের জন্য টর্চও প্রয়োজন। একটাও অপ্রয়োজনীয় জিনিস নয়। দেব স্যার?
: দাও। আমি অর্থনীতির অধ্যাপক। অপ্রয়োজনীয় কিছু নেব না।
: বৃষ্টি এলে তো ঠান্ডা লেগে যেতে পারে। আমেরিকার বৃষ্টি বাতাস নিয়েই আসে। একটা রেইনকোট গায়ে থাকলে কষ্ট পাবেন না। দেখতেও ভালো দেখাবে। আমাদের সুইস-রেইনকোর্ট আছে। নিয়ে যান স্যার। ভাবীও পছন্দ করবেন।
: দাও। তবে হালকা নীল রঙ। ওই রঙই তোমার ভাবীর পছন্দ।
: অ্যাংলিং খুব টেনশনের বিষয়। শুধু ধূমপান করতে ইচ্ছে করে। সমস্যা সিগারেট নয়, সিগারেটের ছাই। আপনার ব্র্যান্ড?
: বেনসন।
: এক কার্টুন বেনসন, দুটি ম্যাচ এবং একটা অ্যাসট্রে দিলাম স্যার।
: দাও।
: আপনার গাড়িতে কি অ্যাংলিং ক্যাপ আছে?
: নেই।
: ক্যাপ পরে অ্যাংলিং করার মজাই আলাদা। আমি ছুটির দিন গার্ল ফ্রেন্ড অ্যাজারিয়াকে নিয়ে অ্যাঙলিং করি। সে বলে, ক্যাপ ছাড়া নাকি অ্যাংলিং ফুলহীন বাগানের মতো। একটা দিলাম স্যার।
: লাগবে যখন দাও।তবে অতিরিক্ত কিছু নেব না। আমি অর্থনীতির অধ্যাপক।
: আপনি স্যার নিশ্চয় পেনিপেক পার্ক লেকে মাছ ধরবেন, তাই না?
: তুমি কীভাবে জানলে?
: আপনার চেহারা, কথাবার্তা, পেশা আর ব্যক্তিত্ব দেখে মনে হলো এর চেয়ে ভালো লেক ফিলাডেলফিয়ায় থাকলে পেনিলেকেও যেতেন না।
: ঠিক বলেছ। আমি আসলেই সৌখিন।
: অনেক্ষণ মাছ ধরার পর ক্লান্তি আসতে পারে। ক্লান্তি মানে বিশ্রামের আহ্বান। একটা সিংগেল এয়ার মেট্রেস নিয়ে যান। বাতাস ছেড়ে দিলে রুমালের মতো হয়ে যায়। বাসাতেও ব্যবহার করতে পারবেন।
: দাও।
: বিশ্রামে গেলেও স্যার অনেক সময় ঘুম আসে না। আপনাদের মতো বোদ্ধা মানুষের বই ছাড়া ঘুম আসার কথা না। আমার চাচাও অধ্যাপক। তিনি বই ছাড়া বিছানায় যান না। আমাদের দোকানে পৃথিবীর সব দেশের সব ভালো বই আছে। আইজাক ওয়াল্টনের(Izzak Walton) দ্যা কমপ্লেট অ্যাংলার (The Compleat Angler) বইটা নিতে পারেন।
: শুনেছি বইটা ভালো। দাও।বই কখনো অতিরিক্ত হয় না।
: অ্যাংলিং খুব নেশা। ধরুন, আপনার অনেক রাত হয়ে গেল। বাসায় গিয়ে ভাবীকে ডাকলে রাগ করতে পারেন। স্ত্রীদের বিশ্বাস নেই। লেকের পাশে আমাদের একটা হোটেল আছে। খুব ভালো। আপনি ফোন করার সঙ্গে সঙ্গে হোটেলের লোক এসে জামাই আদরে নিয়ে যাবে। একটা রুম বুকিং দিয়ে দিই স্যার?
: দাও।
: সকালে আপনি বাড়ি গেলেন। এতক্ষণ কোথায় ছিলেন কৈফিয়ত চাইতে পারেন ভাবী। মাছ দেখলেও মন গলবে না। বলতে পারেন, মাছ এনেছ মসলাপাতি কই, তেল কই? কিছু মসলা আর ভাবীর জন্য কসমেটিক্স দিই?
: দাও।
: বাচ্চাদের জন্য কী দেব স্যার?
: আমার বাচ্চা নেই।
: তাহলে স্যার বব ডিলনের কয়েকটা ক্যাসেট দিয়ে দিই?
: দাও। তবে অতিরিক্ত কিছু নেব না। আমি অর্থনীতির অধ্যাপক।
: অনেক্ষণ বসে থাকলে কোমড়ে ব্যথা হতে পারে। এক প্যাকেট পেইনকিলার নিয়ে যান। কাজে আসতে পারে। বিপদের বন্ধু।
: দাও।
: বিল কতো হলো?
: দুই হাজার ছয়শ ডলার।
চমকে উঠলেন অধ্যাপক। বিল দিতে যাওয়ার আগে সেলসম্যান কুপার দৌঁড়ে এসে বললেন : বিরাট ভুল হয়ে গেছে। লেন্ডিং নেটস, ক্যাস্ট নেটস, ওজন মাপার স্কেল, ফিশিং রড হোল্ডার, প্লাইয়ারস, গ্রিফার্স, হুক রিমোভার, বাইট এলার্ম, রড কেইস, টিউব, র‌্যাকস এসব নেওয়া হয়নি। এগুলো ছাড়া ফিশিং হয় না। দিয়ে দিচ্ছি স্যার?
: দাও। আমি অর্থনীতির অধ্যাপক। আর কিছু নেব না। মোট কত হলো?
: তিন হাজার পাঁচশ ডলার।
: কিন্তু স্যার আর একটা সমস্যা আছে। এতসব জিনিস দেখলে ভাবী ক্ষেপে যেতে পারেন। তখন কী করবেন?
: তাই তো? কী করব?
: আপনাদের মতো শিক্ষিত লোক বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করতে পারেন না। কিছু বলতেও পারবেন না, কথাগুলি কানে আসবে বজ্র হয়ে। আমি স্যার, একটা জিনিস দেব। ধরেন, আমার পক্ষ থেকে। ওটি নিলে ভাবীর সব চিৎকার অর্থহীন হয়ে যাবে। দেব স্যার? মাত্র পাঁচ ডলার।
: কী সেটা?
: এয়ার মাস্ক। কানে দিলে আণবিক বোমা ফাটলেও শুনবেন না। দেব স্যার?
: দাও। এক্ষুণি লাগিয়ে নিই। যাতে তোমার কথাও কানে না আসে। নইলে ফতুর হয়ে যাব। তুমি বউয়ের চেয়েও মারাত্মক, তোমার কথা বউয়ের চেয়েও ক্ষতিকর।

Tuesday 19 December 2017

তিনে দুয়ে দশ কিশোর উপন্যাসের ভূমিকায় হায়াৎ মামুদ / অধ্যাপক ড. একেএম আখতারুল কবীর

‘তিনে দুয়ে দশ’ ড. মোহাম্মদ আমীন-এর লেখা একটি অনবদ্য কিশোর উপন্যাস। কিশোরদের
ড. মোহাম্মদ আমীন
মনমানসিকতাকে আদর্শ চেতনায় জাগ্রত করতে হলে তাদের কেমন হতে হয়,  সেটি ছাড়াও এ বিষয়ে অভিভাবক, শিক্ষক ও সমাজের কর্তব্য কী, তা অতি হৃদয়গ্রাহী ভাষায় অনুপম এক গল্পের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। লেখকের জীবন থেকে নেওয়া এই গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে পুথিনিলয়। পাওয়া যাবে আগামী ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের অমর  একুশে গ্রন্থমেলার  পুথিনিলয় স্টলে। প্রচ্ছদ করেছেন মামুন হোসাইন। শুধু উপন্যাসটি নয়, ভূমিকাও অনবদ্য। হায়ৎ মামুদের লেখা ভূমিকা পড়লে আপনার অনুভূতিতে অন্যরকম আলোড়ন সৃষ্টি হবে। এমন ভূমিকা আমি আর কখনো পড়িনি। দেখুন, কেমন বইটর ভূমিকা।  
                                                                                 ভূমিকা
                                                                       
অধ্যাপক ড. হায়াৎ মামুদ
‘তিনে দুয়ে দশ’ কীভাবে হয়?
ড. মোহাম্মদ আমীন বললেন, পড়ে দেখুন।
বই পড়তে পড়তে বুড়ো হয়ে গেলাম, কী আর পড়ব!  ভেবেছিলাম, দুই এক পৃষ্ঠা পড়ে একটা ভূমিকা লিখে দেব। পারলাম না, ইচ্ছাকে প্রতিহত করা কঠিন কাজ। প্রথম অধ্যায় শেষ করার পর দ্বিতীয় অধ্যায়, আমাকে এমনভাবে টানতে লাগল যে, স্থির থাকতে পারলাম না। অধীর আগ্রহে ঝাঁপ দিলাম দ্বিতীয় অধ্যায়ে। শব্দ চয়ন, কথোপকথন, টানটান ঘটনা পরম্পরা, কিশোর ওমরের বুদ্ধিদীপ্ত পদচারণা-দুষ্টময় উদ্ভাস, সেলিমার বিচক্ষণতা এবং শিক্ষকের কুশলী ধৈর্য আমাকে বিমোহিত করে দিল। পড়তে পড়তে, আমি বুড়ো বয়সেও কিশোরের মতো চঞ্চল হয়ে উঠলাম। অনিচ্ছারাশি আগ্রহের চূড়োয় উঠে গেল। কৈশোরময় আগ্রহে নিজেকে  হারিয়ে ফেলি। আমি এগিয়ে যাচ্ছি কৈশোর হতে কৈশোরে। হঠাৎ দেখি উপন্যাস শেষ হয়ে গেল?
এত তাড়াতাড়ি শেষ করে দিলে যে?
লেখক বললেন,  কিশোর বয়স তো তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়।
আমি বললাম, না। এমন বুদ্ধিদীপ্ত বইয়ের মাধ্যমে যে কোনো বয়সকে কৈশোরের মতো প্রাণবন্ত
সজীবতায় চিরন্তন করে রাখা যায়। তোমার, ‘দুয়ে তিনে দশ’  উপন্যাসটি আমার অশীতিপর বৃদ্ধত্বকেও ষোড়শোন্মদনায় প্রকৃতির মতো নির্ঝর উচ্ছ্বাসে কিশোর করে দিয়েছিল।
সম্পূর্ণ ভিন্ন  আঙ্গিকে লেখা কিশোর উপন্যাসটি কিশোরদের শুধু আনন্দ দেবে না, বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার অনুপ্রেরণাও জোগাবে। সর্বোপরি, কিশোরদের সঙ্গে মা-বাবা ও পরিবেশের মধ্যে কেমন সম্পর্ক হওয়া উচিত -- তাও অনবদ্য বাস্তবতায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এমন একটি কিশোর উপন্যাস পড়তে পেরে আমি সত্যি বিমোহিত।  
অধ্যাপক হায়াৎ মামুদ 
                                                                                  

তিনে দুয়ে দশ কিশোর উপন্যাসের শেষ অধ্যায় / প্রমিতা দাস লাবণী

তিনে দুয়ে দশ ড. মোহাম্মদ আমীন-এর লেখা একটি কিশোর উপন্যাস। বইটির সার সংক্ষেপ ডিসেম্বরের চার তারিখ Mohammed Amin এর ফেসবুকে প্রকাশের পর রীতিমতো হুলুস্থুল পড়ে গিয়েছিল। লাইক-শেয়ার ছাড়াও গল্পটি হাজার হাজার কপি করে অনেকে নিজেদের টাইম লাইনে নামে-বেনামে চালিয়ে দিতে থাকে। এমনকি CU Friends নামের একটি গ্রপে জনৈক Arshad Uddin নামের একজন লেখকও এটি নিজের নামে পোস্ট করে প্রশংসায় প্রশংসায় ফুলে উঠেন। অনেকে এমন চৌর্যবৃত্তির প্রতিবাদও করেছেন। উপন্যাসটি ছোট, দামও কম; মাত্র ১০০ টাকা। কিন্তু এর ভিতরে যা রয়েছে, তার প্রতিটি লাইন একজন কিশোরকে, একজন অভিভাবককে, একজন শিক্ষককে আদশ চেতনায় ঋদ্ধ করার  পূর্ণ উপাদানে বিভূষিত। এরকম একটি কিশোর উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে আর আছে কিনা আমার জানা নেই। দেখুন বইটির শেষ অধ্যায়।
শেষ অধ্যায়
বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলো। ওমর পনের দিনের জন্য ইউরোপ ভ্রমণে যাবে। আমার পড়ার চাপ বেড়ে গেছে। সেলিমা ছুটি দেয়নি। আকিদ-মুহিবকেও পড়াতে হবে। 
ডিআইজি সাহেব বললেন, পনের দিন পর চলে আসবেন।  আমি সেলিমাকে ফোন করব।
আমি বললাম, আমার জন্য আপনার বাসা অনেক দূরে। সামনে ইয়ার ফাইনাল। ওমরের এখন সমস্যা নেই। একজন ভালো টিচার দিই?
বুসিফেলাসকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আলেকজান্ডার প্রয়োজন। আমার ছেলে বুসেফিলাস, আপনি আলেকজান্ডার।
আমি মেসে চলে এলাম। একা হলে মনে চলে আসে ওমর। তার হাসি, হতভম্ব করে দেওয়া কথা, বুদ্ধিদীপ্ত মন্তব্য, হঠাৎ বিব্রতকর মন্তব্যে মাথা-গরম করে দেওয়া পরিবেশ-- আমাকে ডুবিয়ে রেখেছে ওমরে। সতের কী আঠার দিন পর মেসের বাবুর্চি এসে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, স্যার ওমর আইস্যে। ওঁয়ারে একজন ভদ্দরলোক, মনে অয় ডিআইজি সাব। রাজিব স্যারও আছে।
আমি গিয়ে সালাম দিলাাম।
ওমর সালাম দিল। আমি হতবাক। এ প্রথম সে আমাকে সালাম দিল।
তুমি সালাম দিতে শিখেছ?
ওমর বলল, টিচার, বাবা আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।
তুমি  ডিআইজি স্যারকে বাবা ডাক?
লজ্জার হাসি দিয়ে ওমর বলল,  ডিআইজি কারো বাবা হতে পারে না। আপনি বলেছিলেন, বাবা বাবাই।
ডিআইজি সাহেব বললেন, টিচার, আমার ছেলে বার্ষিক পরীক্ষায় তৃতীয় হয়েছে। কলেজিয়েট স্কুলের মতো প্রতিষ্ঠানে প্রথম হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। ষষ্ঠ থেকে নবম পর্যন্ত তার রোল পঞ্চাশেও ছিল না। এক বছরের মধ্যে আপনি আমার অপদার্থ ছেলেটাকে হীরের টুকরো বানিয়ে দিয়েছেন।
আমি বললাম, আপনার ছেলে হীরে নয়, অ্যান্টিম্যাটার। এস্তেতিনের মতো দুর্লভ। প্রথম দিনেই আমি চিনে ফেলেছিলাম।
আমি জানি না কীভাবে এমন অবিশ্বাস্য পরিবর্তন সম্ভব হলো।
প্রশংসা আমার মনে অদ্ভুত এক আনন্দ বইয়ে দিল। আমি মাটির দিকে তাকিয়ে। মেসের সব সদস্যরা বাইরে এসে ডিআইজি সাহেবকে অভিবাদন জানিয়ে ঘিরে ধরেছে।
মেস ম্যানেজার প্রদীপ বলল, স্যার ভেতরে আসুন ।
ডিআইজি সাহেব মেসে ঢুকে আমার হাতে একটা ঘড়ি তুলে দিয়ে বললেন, ছোট ভাই সুইজারল্যান্ড থেকে এনেছেন। হাতে দিতে গিয়ে দেখলাম, আমার হাতের চেয়ে যোগ্য আর একটা হাত রয়ে গেছে। সে হাতেই কেবল এমন দামি ঘড়ি মানায়। তাই নিয়ে এলাম আপনার হতে পরানোর জন্য। হাতটা দিন, আমি নিজেই পরিয়ে দেব।
বাম হাত এগিয়ে দিতে লজ্জা করছিল, ডান হাত এগিয়ে দিলাম। ডিআইজি সাহেব বললেন, বাম হাত দিন।
তাঁর কথার বিচ্ছুরণ আমাকে এমনভাবে ছুঁয়ে দিচ্ছিল আমি সম্মোহিতের মতো বাম হাতটা এগিয়ে দিলাম। তিনি আমার বাম হাতে ঘড়িটা পরিয়ে দিয়ে বললেন, এটি কোনো বস্তু নয়, ভালোবাসা।
আনন্দে আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। এমনভাবে কেউ আমাকে কোনোদিন উপহার দেননি। স্বর্ণ মোড়ানো রাডো ঘড়িটার দাম অর্ধ লাখের কম নয়।ওমর আমার পায়ে ধরে সালাম করে বলল, স্যার, আপনি আমাকে বদলে দিয়েছেন।
আমি তো টিচার!
আপনি আমার স্যার।
আমি কখনও তোামার স্যার হবো না, টিচার ডাকবে।
ওমর আমার হাতে গিফ্ট্ পেপার মোড়ানো একটা প্যাকেট দিয়ে আবার পা ছুঁয়ে সালাম করে বলল, টিচার, এটি নেন।
কী?
আপনি প্রতিমাসে আমার কাছে যে টাকাগুলো জমা রাখতেন সেগুলো।
ওমরের আচরণ দেখে আমার চোখে সত্যি সত্যি জল এসে গেল। আমি তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলাম, কিছু বলতে পারলাম না। আমার লেখা কবিতার দুটো লাইন নিজের অজান্তে বলে দিলাম,
     স্বপ্ন  যেখানে রুদ্র কঠিন, করাল ভীষণ অন্ধকার
     প্রকৃতি সেখানে মৃণ্ময় বিলাস মিলেমিশে একাকার।
ডিআইজি সাহেব ওমরের এমন আচরণে কেমন জানি আবেগপ্রবণ হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,  টিচার, ওমর আমাকেও পাত্তা দিত না। এ পিচ্চি ছেলের কাছে আমি ছিলাম কেবল ডিআইজি। কোনোদিন ভাবিনি বাবা ডাক শুনব। আপনি তাকে জানোয়ার থেকে মানুষ করে দিয়েছেন। বলুন কী দিয়ে এমন অসম্ভবকে  সম্ভব করেছেন?
আমি বললাম, ভালোবাসা, শুধুই ভালোবাসা।
ডিআইজি সাহেব বললেন, আপনি আমার কাছ থেকে কী চান? গাড়ি-বাড়ি, টাকা, চাকরি, বিদেশ ভ্রমণ? যা চান তাই দেব।  বলুন কী চান?
ভালোবাসা, শুধুই ভালোবাসা।
ওমর বলল, সবার দেওয়া নেওয়া হলো। টিচার আমাকে কিছু দেবেন না?
বললাম, কী চাও?
ভালোবাসা, ভালোবাসা এবং ভালোবাসা।

Friday 3 November 2017

অর্হণা / প্রমিতা দাস লাবণী

অর্হণা
অর্হণা তৎসম শব্দ। এর ব্যুৎপত্তি হলো ‘অর্হ+অন্‌+ আ (টাপ্‌)’। এটি বিশেষ্য হিসেবে বাক্যে ব্যবহৃত হয়। এর অর্থ পূজা; সম্মান, যোগ্য, শ্রেষ্ঠ, উপযুক্ত প্রভৃতি অর্থেও শব্দটি ব্যবহৃত হয়। বাংলা ভাষায় বর্তমানে শব্দটির ব্যবহার বেশ অপ্রতুল এবং সেহেতু এটি অপরিচিতই বলা যায়। ইদানীং শব্দটি বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছে।  এর কারণ ড. মোহাম্মদ আমীন এবং তার লেখা উপন্যাস ‘অর্হণা’। অর্হণা  এখন কেবল অভিধানে বন্দি শব্দমাত্র নয়। এটি এখন ‘উপন্যাস’, লেখক ড. মোহাম্মদ আমীন। তাই ‘অর্হণা’ অধুনা অভিধানের গণ্ডি ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে পাঠকে আগ্রহে আগ্রহে, সাধারণে মনে।

‘অর্হণ’ স্যমন্তক সিরিজের দ্বিতীয় উপন্যাস। লেখক কলকাতায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “যতদিন রচনা বেঁচে
থাকবে ততদিন স্যমন্তক সিরিজের বই প্রকাশিত হতে থাকবে।” যদি আপনি মারা  যান তখন কী হবে? একজন সাংবাদিকের এই প্রশ্নে লেখক বলেছিলেন, তখন যারা জীবিত থাকবেন, তারাই এর উত্তর দেবে। অর্হণা এখনো প্রকাশিত হয়নি। জানুয়ারি মাসে বইটি প্রকাশিত হবে এবং বাংলাদেশের ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা, ২০১৭’- এর পুথিনিলয় স্টলে পাওয়া যাবে। বইটির পাণ্ডুলিপি পড়ে আমি আনন্দ, রোমাঞ্চ আর ঋদ্ধ সঞ্চয়নে অভাবনীয়ভাবে অলংকৃত হয়েছি। এমন বৈচিত্র্যময় প্রেক্ষাপট একসঙ্গে আর কোনো উপন্যাসে পাইনি। বিশেষ করে মনোহর বাক্য-বিন্যাস ও হৃদয়মথিত কথোপকথন আমাকে মুগ্ধতার শেষ প্রান্তে নিয়ে গিয়েছিল। 

শুধু বাংলাদেশ নয়, প্রায় পুরো পৃথিবী এই উপন্যাসের ক্ষেত্র। উভয় বাংলার কালজয়ী কবিসাহিত্যিকগণ এই উপন্যাসের মূল চরিত্র। এছাড়াও রয়েছে বিশ্বসাহিত্যের নামকরা কয়েকজন পণ্ডিত। 
বিংশ শতকের অর্ধশতাধিক খ্যাতিমান সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, কুটনীতিবিদ, রাজনীতিক, চিকিৎসক, সাংবাদিক এবং তাদের গুণান্বিত আলোচনার বিরল বাক্যে ‘অর্হণা’ সজ্জিত হয়েছে পাঠকদের জন্য। উপন্যাসের নায়ক-নায়িকা থেকে প্রায় সব চরিত্র খ্যাতিমান ও পরিচিত। এমন গুণবান ও প্রসিদ্ধ ব্যক্তিদের নিয়ে লেখা উপন্যাস অর্হণা’ পড়তে শুরু করলে নিজের অজান্তে চলে যেতে হয় সে গুণবানদের আলাপচারিতায়--- ঢাকা থেকে কলকাতা হয়ে লন্ডন, জার্মান আমেরিকা; আফ্রিকা থেকে আরো সুদূরে, জ্ঞানবানদের একান্ত আসরে।  এবার বলছি এই উপন্যাসের কয়েকজন চরিত্রে নাম।

আহমদ ছফা, অন্নদাশঙ্কর রায়, ড. মফিজ আলী চৌধুরী, আহমদ শরীফ, কবীর চৌধুরী, ডাক্তার নুরুল ইসলাম, শামসুর রাহমান, সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সৈয়দ শামসুল হক, আবদুল গাফফার চৌধুরী, সরদার ফজলুল করিম, মযহারুল ইসলাম, আবদুল মাননান সৈয়দ, নরেন বিশ্বাস, আল মাহমুদ, হুমায়ুন আজাদ, আবদুল কাইউম, আসকার ইবনে সাইখ, শফিউদ্দীন আহমেদ, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, প্রফেসর গ্রিয়েল, প্রফেসর ব্রুম, প্রফেসর মিন্ড্রা, শ্রাবন্তীনাহা, শাহিদা সুলতানা, অরুণাভ সরকার, আবদুল আলিম, নাজিম উদ্দিন মোস্তান, ওসমান গনি, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, হায়াৎ মামুদ, বুদ্ধদেব বসু, সৈয়দ আলী আহসান, কে এম শিহাব উদ্দিন, আখতারুজ্জামান বাবু, প্রফেসর কোবাইসি মাসাহিতো, অধ্যাপক টিআই চোধুরী, ভাষাবিষারদ প্রফেসর রচনাসহ আরও অনেক কালজয়ী কবি-সাহিত্যিক এই উপন্যাসের চরিত্র।

অর্হণা উপন্যাসের ভূমিকা লিখেছেন  হায়াৎ মামুদ। তিনি নিজেও উপন্যাসের একটি চরিত্র। চরিত্র দিয়ে বর্ণিত 
ড. মোহাম্মদ আমীন
 ভূমিকাসমৃদ্ধ উপন্যাস ইতোঃপূর্বে আমি পড়িনি। তাই ‘অর্হণা’ ছিল আমার কাছে একটি নতুন ধারণার বিকাশ। ভূমিকায় হায়াৎ মামুদ লিখেছেন, “সমাজ, রাষ্ট্র, সাহিত্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে প্রেম-ভালোবাসা আর মানবীয় মূল্যবোধের সুষমিত প্রগাঢ়ত্বের সঙ্গে এতগুলো বিস্ময়কর চরিত্রের চরিত্রায়ণ উপন্যাসটিকে করে তুলেছে অনবদ্য। চরিত্রের সঙ্গে কথোপকথন, সজ্জা আর তথ্যের গ্রহণযোগ্যতা এতই নিবিড় যে, অনুভবকেও হার মানিয়ে দেয়। এমন একটি উপন্যাস বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করবে -- এ বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। ” হায়াৎ মামুদ আরো লিখেছেন, “উপন্যাসে চরিত্রবর্গের আলাপচারিতায় সমকালীন সাহিত্য-সংস্কৃতি, সংস্কার-কুসংস্কার, ধর্ম, আর্থ-রাজনীতি ও সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে যে তথ্য-উপাত্ত নির্দেশিত হয়েছে তা গভীর পর্যবেক্ষণের সঙ্গে অভাবিত আন্তরিকতাপুষ্ট ঋদ্ধ দ্যোতনায় দ্যোতিত। সর্বোপরি উপন্যাসের নায়িকা কল্পনার সঙ্গে নায়কের ভীষণ স্পর্শকাতর সম্পর্ক পাঠককে নুতন ভাবনায় মারাত্মক দ্বিধায় ফেলে দেবে। বাংলা সাহিত্যেকে এমন একটি অসাধারণ উপন্যাস উপহার দেওয়ার জন্য আমি লেখক ড. মোহাম্মদ আমীনকে গভীর কৃতজ্ঞতা জানাই।”

নিজেই চরিত্র তাই হায়াৎ মামুদ অতিরিক্ত প্রশংসা করে ফেললেন কিনা তা দেখার ইচ্ছা পাণ্ডুলিপি পাঠকে আরো তরান্বিত করে দিলাম।না, অতিরিক্ত কিছু তিনি লিখেননি। তাঁর লেখা যথার্থ এবং পাণ্ডুলিপি আদ্যপান্ত পাঠ করেই অর্হণার ভূমিকা লিখেছেন। অর্হণার আলোচনায় বিশিষ্ট সমালোচক এরশাদ হোসেন আবীর লিখেছেন, এমন জীবন্ত উপন্যাস আমি আর পড়িনি। দেখুন পরিচিত নায়ক-নায়িকাদের নিয়ে লেখা উপন্যাস পড়তে কত ভালো লাগে। আপনার মনে অজানা এক শিহরন দেবে প্রেমে আর বোদ্ধমায় সমৃদ্ধতায়। প্রতিটি লাইন স্মরণীয় বাণী হয়ে অনেকদিন মোহিত রাখবে আপনাকে।

উপন্যাসটি  কেমন হবে? এই প্রশ্নের উত্তরে আমি বলব, ভাষা  মানুষকে এখনো এমন হাতিয়ার দিতে পারেনি, যদ্দ্বারা মানুষ তার সব উপলব্ধিকে বাক্য-ভাষায় অন্যের কাছে প্রকাশ করতে পারে। তেমনি অর্হণার পাণ্ডুলিপি পারে আমার
প্রমিতা দাস লাবণী
  অনুভবে সঞ্চারিত আবেশরাশিকে সম্পূর্ণরূপে কথায় প্রকাশ করতে পারব না। শুধু বলবো, অসাধারণ, অসাম, হৃদয়কাড়া একটি উপন্যাস।যার প্রত্যেকটি লাইন নীরব চন্দ্রিমায় রাতের কোলে ঘেষেও জোছনাকে বাক্য বানিয়ে পাঠকের মনে বিপুল ঝড় তুলে দিতে নিমিষ চিন্তার মতো কিন্তু প্রকৃতির মতো বিরল স্থায়িত্বে। তাই বইটি কেমন? প্রশ্নের উত্তরে দ্বিধাহীনভাবে বলতে পারি, এর অবিকল উত্তর পেতে হলে ‘অর্হণা’ পড়তে হবে। অর্হণা এমন একটি উপন্যাস যা আপনাকে বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবিসাহিত্যিক ও পণ্ডিতবর্গের বন্ধু বানিয়ে দিতে সক্ষম হব।  আমি বলব, অর্হণা শুধু উপন্যাস নয়, পাঠকের তীর্থভূমি। যেখানে প্রকৃতি বিছিয়ে রেখেছে তার অশেষ ঐশ্বর্য থরে থরে। ‘অর্হণা’রূপ উপন্যাসের তীর্থক্ষেত্র থেকে আপনি পেতে পারেন সাহিত্যের নির্ঝর সমৃদ্ধি, বিমল মুগ্ধতা। পরিচিত হতে পারেন বাংলা ও বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে।

প্রকৃত অর্থে  প্রকাশের আগে এমন একটি অসাধারণ উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি পড়তে দিয়ে স্যার (ড. মোহাম্মদ আমীন) আমার প্রতি তাঁর স্নেহ-ভালোবাসার যে নিদর্শন দেখিয়েছেন তা আমার হৃদয়ে তীক্ষ্ণ-গভীর ভালোবাসায় নিরূপম শ্রদ্ধা হয়ে আমাকে আরো মুগ্ধ করে দিলেন-- 
প্রণাম আমার 
নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে।
যুগে যুগে মহিমার।

Wednesday 1 November 2017

বাঙালির বাংলা হাসি / অধ্যাপক টি আই চৌধুরী

বাঙালির বাংলা হাসি 

আপনি কী বাংলা ব্যাকরণ ও বাংলা বানান পড়ে হাসতে হাসতে উদ্বেল হয়ে যেতে চান
হাসির মাঝে? আপনি হাসির মাঝে শুদ্ধ বাংলা শিখে নিজেকে বিশুদ্ধ করে তুলতে চান মাতৃভাষার আলয়ে? তাহলে ড. মোহাম্মদ আমীনের লোখা ‘বাঙালির বাংলা হাসি’ বইটি কিনবেন। অসাধারণ এই বইট কৌতুকের রাজ্যে ভিন্ন আমেজ এনে দিয়েছে। প্রকাশ হবে আগামী অমর একুশে গ্রন্থমেলায়, প্রকাশক : পুথিনিলয়, বাংলাবাজার, ঢাকা।  প্রচ্ছদ : মামুন হোসাইন। বইটি পুথিনিলয়ের স্টলে পাওয়া যাবে।
বইটি পড়লে কী মজা পাবেন, কত হাসি আপনাকে হাসাবে প্রতিটি কৌতুক সে সম্পর্কে একটি ধারণা দেওয়ার জন্য নিচে বইটির একটি কৌতুক (কৌতুক নম্বর : ১২২) দেওয়া হলো।
***********

কবি আবদুস সাত্তার সাপ্তাহিক বিক্রম পত্রিকায় কাজ করতেন। ‘বিক্রম’-এর এক সংখ্যয় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর একটা লেখা প্রকাশিত হলো। সদ্য-প্রকাশিত পত্রিকার একটা কপি নিয়ে কবি আবদুস সাত্তার খুশিতে ডগমগ হয়ে ড. শহীদুল্লাহ্র কাছে গেলেন।
 ড. মোহাম্মদ আমীন
ড. শহীদুল্লাহ্ পত্রিকার দিকে কিছুক্ষণ চোখ বুলিয়ে বললেন, সাত্তার, জায়নামাজে আমি কখন পাদকর্ম করলাম?
আবদুস সাত্তার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে শহীদুল্লাহ্র দিকে তাকিয়ে বিনীত কণ্ঠে বললেন, কিছুই তো বুঝতে পারলাম না স্যার।ড. শহীদুল্লাহ বললেন, আমি লিখেছিলাম, জায়নামাজে যখন পা দিলাম ...। আর তোমরা ছাপিয়েছ, জায়নামাজে যখন পাদিলাম...। পাদকর্ম, তা-ও আবার জায়নামাজে। তোমরা কী ছাইপাশ ছাপও এসব?কবি আবদুস সাত্তার অপরাধীর কণ্ঠে বললেন, কম্পোজিটরের ভুলে ‘পা-এর সঙ্গে ‘দিলাম’ যুক্ত হয়ে গেছে।ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বললেন, ‘পা’ এর সঙ্গে দিলাম যুক্ত হয়ে গিয়েছে ঠিক আছে, কিন্তু আমার উপর কেন এমন দোষটা চাপিয়ে দিলে?পরদিন পত্রিকা সংশোধন দিল, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ জায়নামাজে পাদেন নি। তিনি পাদিয়েছিলেন।এবার পা আর দিয়েছিলেন যুক্ত হয়ে গেল।ড. শহীদুল্লাহ্ লেখা দেখে হায়! হায়! করে ওঠলেন।

অর্হণা উপন্যাসের জীবন্তায়ন / এরশাদ হোসেন আবীর

অর্হণা 

অর্হণা (Ar'haṇā) একটি উপন্যাস।এর লেখক ড. মোহাম্মদ আমীন। তাঁর লেখা বিখ্যাত উপন্যাস ‘স্যমন্তক’। আলোচিত ও প্রশংসিত এই উপন্যাসের দ্বিতীয় কিন্তু স্বয়ংসম্পূর্ণ নির্ঝর খণ্ড অর্হণা। প্রচ্ছদ এঁকেছেন, মামুন হোসাইন এবং প্রকাশক হচ্ছে, পুথিনিলয়, বাংলাবাজার, ঢাকা। বইটির পাণ্ডুলিপি পড়ে আমি এতই মুগ্ধ হয়েছি যে, রিভিউ না লিখে পারলাম না। অর্হণা শব্দের আভিধানিক অর্থ পূজা, সম্মান, যোগ্যতা। ইংরেজিতে বলা যায়, ‍adoration, worthiness প্রভৃতি। 
অন্নদাশঙ্কর রায়, আহমদ ছফা, ড. মফিজ আলী চৌধুরী, আহমদ শরীফ, ডাক্তার নুরুল
ইসলাম, কবীর চৌধুরী, শামসুর রাহমান, সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সৈয়দ শামসুল হক, আবদুল গাফফার চৌধুরী, সরদার ফজলুল করিম, মযহারুল ইসলাম, আবদুল মাননান সৈয়দ, নরেন বিশ্বাস, আল মাহমুদ, হুমায়ুন আজাদ, আবদুল কাইউম, আসকার ইবনে সাইখ, শফিউদ্দীন আহমেদ, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, প্রফেসর গ্রিয়েল, প্রফের ব্রুম, প্রফেসর মিন্ড্রা, শ্রাবন্তীনাহা, শাহিদা সুলতানা, অরুণাভ সরকার, আবদুল আলিম, নাজিম উদ্দিন মোস্তান, ওসমান গনি, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, হায়াৎ মামুদ, বুদ্ধদেব বসু, সৈয়দ আলী আহসান, কে এম শিহাব উদ্দিন, আখতারুজ্জামান বাবু, প্রফেসর কোবাইসি মাসাহিতো, অধ্যাপক টিআই চোধুরী, ভাষাবিষারদ প্রফেসর রচনাসহ আরও অনেক কালজয়ী কবি-সাহিত্যিক এই উপন্যাসের চরিত্র।
অর্হণা উপন্যাসের ভূমিকায়  হায়াৎ মামুদ লিখেছেন, “সমাজ, রাষ্ট্র, সাহিত্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে প্রেম-ভালোবাসা আর মানবীয় মূল্যবোধের সুষমিত প্রগাঢ়ত্বের সঙ্গে এতগুলো বিস্ময়কর চরিত্রের চরিত্রায়ণ উপন্যাসটিকে করে তুলেছে অনবদ্য। চরিত্রের সঙ্গে কথোপকথন, সজ্জা আর তথ্যের গ্রহণযোগ্যতা এতই নিবিড় যে, অনুভবকেও হার মানিয়ে দেয়। এমন একটি উপন্যাস বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করবে -- এ বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। ” 
হায়াৎ মামুদ আরো লিখেছেন, “উপন্যাসে চরিত্রবর্গের আলাপচারিতায় সমকালীন সাহিত্য-সংস্কৃতি, সংস্কার-কুসংস্কার, ধর্ম, আর্থ-রাজনীতি ও সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে যে তথ্য-উপাত্ত নির্দেশিত হয়েছে তা গভীর পর্যবেক্ষণের সঙ্গে অভাবিত আন্তরিকতাপুষ্ট ঋদ্ধ দ্যোতনায় দ্যোতিত। সর্বোপরি উপন্যাসের নায়িকা কল্পনার সঙ্গে নায়কের ভীষণ স্পর্শকাতর সম্পর্ক পাঠককে নুতন ভাবনায় মারাত্মক দ্বিধায় ফেলে দেবে। বাংলা সাহিত্যেকে এমন একটি অসাধারণ উপন্যাস উপহার দেওয়ার জন্য আমি লেখক ড. মোহাম্মদ আমীনকে গভীর কৃতজ্ঞতা জানাই।”
স্যমন্তক উপন্যাসের ভূমিকায় লেখক বলেছিলেন, রচনা (স্যমন্তক-এর নায়িকা) যতদিন বেচেঁ থাকবে আমার উপন্যাস লেখা ততদিন চলতে থাকবে। লেখক কথা রেখেছেন, তাই আমরা শীঘ্রই পেতে যাচ্ছি স্যমন্তক উপন্যাসের দ্বিতীয় খণ্ড। যার নাম অর্হণা!  
স্যমন্তক উপন্যাসের ভূমিকা যেমন প্রাণবন্ত তেমনি অর্হণা উপন্যাসের ভূমিকাও প্রাণবন্ত, অনবদ্য। এমন ভূমিকা পাঠককে গভীর আবেগে টেনে-হিচড়েঁ উপন্যাসের ভেতরে নিয়ে যাবে। অবিশ্বাস্য হলো, স্যমন্তক উপন্যাস প্রথমেই ইতিহাস ও উপন্যাস কাকে বলে বলা ছিল। অর্হণা উপন্যাসের শুরুতেও ইতিহাস ও উপন্যাস নিয়ে কথা রয়েছে।  
লেখকের ভাষায়,  উপন্যাস ইতিহাস নয়, ইতিহাস উপন্যাস নয়। তবুও দুটোর মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।উপন্যাস বাহ্যিক বিষয়াদি পর্যাবেক্ষণ করে থেমে থাকে না, গভীরে
অর্হণার লেখক ও আমি আবীর
ডুকে অন্তরের খবরও বের করে আনে। ইতিহাস কেবলই বাইরের বিষয়াদি দেখে। তাই ইতিহাসের অর্ন্তদর্শন ভাসা ভাসা। ইতিহাস ছবির মতো, ছবি দেখে যেমন মনের খবর পাওয়া যায় না, তেমনি ইতিহাস পড়ে অন্তরের খবর পাওয়া যায় না। এ কাজটি ইতিহাসের চেয়ে উপন্যাস ভালো পারে। উপন্যাস তথ্য- তথ্যের সঙ্গে কল্পনার সরস মুগ্ধতা দিয়ে পরিবেশিত হয়। এখানে হৃদয় কল্পনাকে নিয়ে খেলে, কল্পনা খেলে হৃদয়কে নিয়ে।
অর্হণা উপন্যাসে কিন্তু কল্পনা ও হৃদয় গভীর দাগ কাটবে! কারণ অর্হণা উপন্যাসটি কল্পনাকেই উৎসর্গ করা হয়েছ!  এমন জীবন্ত উপন্যাস আমি আর পড়িনি। দেখুন পরিচিত নায়ক-নায়িকাদের নিয়ে লেখা উপন্যাস পড়তে কত ভালো লাগে। আপনার মনে অজানা এক শিহরন দেবে প্রেমে আর বোদ্ধমায় সমৃদ্ধতায়। প্রতিটি লাইন স্মরণীয় বাণী হয়ে অনেকদিন মোহিত রাখবে আপনাকে।
এমন চমৎকার ভূমিকা পড়েই অর্হণা পড়ার লোভ সামলানো দায়! কিন্তু কী আর করা, অপেক্ষার মধুর আনন্দ থেকে পাঠককে এ মুহূর্তে বঞ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ বইটি এখনো প্রকাশিত হয়নি, হবে।  পাওয়া যাবে আগামী অমর একুশে গ্রন্থমেলায় (২০১৮) পুথিনিলয়-এর স্টলে। দাম? দুইশ টাকার কম।
২/ ১১/ ২০১৭ খ্রি.


Monday 13 February 2017

স্যমন্তক সম্পর্কে আমার স্ত্রী বিভার অভিমত/ প্রফেসল দীপক কুমার নাগ

স্যমন্তক সম্পর্কে আমার স্ত্রী বিভার অভিমত / প্রফেসর দীপক কুমার নাগ

বিভা

স্যমন্তক সম্পর্কে আমার স্ত্রী বিভার অভিমতস্যমন্তক উপন্যাসের কয়েক পৃষ্ঠা পড়ার পর আমার স্ত্রী বিভা হঠাৎ বলে বসল, কি গো, তুমি যে মহত্তের কথা বলেছিলে, বইতে তো ঠিক তা নেই। মনে হচ্ছে নায়কের (লেখক) সঙ্গে বইয়ের নায়িকার প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে।
আমি বললাম, বইটি পড়ে শেষ করো। মন্তব্য পরে করো।
আমার স্ত্রী বইটি পড়া শেষ করে বললেন, আমাদের সমাজে এ ধরণের লোক কি সত্যিই আছে? লেখক যদি আমার বয়সে বড়ো হয়ে থাকে তাহলে তাকে আমার প্রণাম দিও। আর বয়সে যদি ছোটো হয়ে থাকে বাসায় নিয়ে আসবে। আমি তাকে আশীর্বাদ করব।

Friday 20 January 2017

স্যমন্তক অনবদ্য এক উপন্যাস / হায়াৎ মামুদ

অধ্যাপক ড. হায়াৎ মামুদ

উপন্যাস নির্মল আনন্দের উৎস। তাই সাহিত্যজগতে উপন্যাস সবচেয়ে জনপ্রিয়। কোনো কোনো উপন্যাস পাঠকের মনে গভীর দাগ কাটে। উপন্যাসের অচেনা-অজানা চরিত্রসমূহে মনপ্রাণ একাকার হয়ে যায়। গভীর নিবেশে আবেশিত হয়ে ওঠে হৃদয়। ব্যক্তিগতভাবে অচেনা চরিত্রগুলোও ভাবনায় শিহরণ তোলে। যদি আপনি এমন একটা উপন্যাস পড়েন, যার প্রায় সবকটি চরিত্র আপনার পরিচিত, শ্রদ্ধার্হ,
খ্যাতিমান ও প্রিয়- তাহলে কেমন লাগবে? কেমন শিহরিত আনন্দে কেঁপে উঠবে অনুভূতি? ভাষায় এটি প্রকাশ করা যায় না। তবে, স্যমন্তক উপন্যাস পড়লে এমন বিরল অনুভূতির পুরোটাই আস্বাদন করতে পারবেন। পরিচিত চরিত্রসমূহের বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপ ‘স্যমন্তক’ উপন্যাসের অন্যতম আকর্ষণ। প্রতিটি লাইনই মুখস্থ করে রাখার মতো। অন্তত এজন্য হলেও ড. মোহাম্মদ আমীনের লেখা ‘স্যমন্তক’ পড়ে দেখতে পারেন। 
স্যমন্তক কোনো সাধারণ উপন্যাস নয়। বাস্তবতার নিরিখে রচিত এ উপন্যাসের শৈল্পিক বিবরণ বস্তি
স্যমন্তকের প্রচ্ছদ
হতে রাজপ্রসাদ পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রেসিডেন্ট, মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং নব্বইয়ের দশকে বাংলা সাহিত্যের উদীয়মান অধিকাংশ সাহিত্যিক, শিক্ষক, প্রশাসক ও বুদ্ধিজীবী স্যমন্তকের চরিত্র। উদাহরণস্বরূপ কবীর চৌধুরী, হাসনাত আবদুল হাই, হুমায়ুন আযাদ, জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, আলাউদ্দিন আল আযাদ, ইতিহাসবেত্ত আবদুল হক, মনিরুজ্জামান, আনিসুজ্জামান, হায়াৎ মামুদ, অরুণাভ সরকার, এস এম সুলতান, নরেন বিশ্বাস, দেলোয়ার হোসেন, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আহমদ ছফা প্রমূখের নাম উল্লেখ করা যায়। আমার একজন ছাত্রী স্যমন্তকের নায়িকা। বস্তিতে বেড়ে ওঠা এ মেয়েটা এখন অক্সফোর্ডের অধ্যাপক। বস্তি থেকে অক্সফোর্ড- কীভাবে সম্ভব হলো? বস্তুত এর অনাস্বাদিতপূর্ব বিবরণই স্যমন্তক। 
স্যমন্তক কী ধরণের উপন্যাস? নানামুনির নানা মত। কেউ বলেন, মনস্তত্বমূলক উপন্যাস। কেউ বলেছেন, আত্মজীবনীমূলক স্মৃতিচারণ। কারও কাছে এটি চেতনাপ্রবাহমূলক উপন্যাস। এক ঔপন্যাসিক
স্যমন্তকের লেখক ড. মোহাম্মদ আমীন
বলেছেন, এটি কাব্যধর্মীমূলক প্রেমকাহিনি, একজন বলেছেন সামাজিক উপন্যাস। কযেকজন এটাকে আর্থ-সমাজিক প্রেক্ষাপটে বিধৃত ঐতিহাসিক উপন্যাস হিসাবেও মন্তব্য করেছেন। বিখ্যাত একজন সমালোচকের ভাষায়, এটি উদ্দেশ্যমূলক কাহিনি উপন্যাস। লেখকের মতে, জৈবন্তিক উপন্যাস। আমার মতে, এটি এখানে বর্ণিত সবধরণের উপন্যাসের সমন্বয়ে গঠিত একটি ব্যাষ্টিক উপন্যাস। যেখানে সকল প্রকার উপন্যাসের স্বাদ একসঙ্গে পাওয়া যায়। এ যেন একের ভেতর অনন্ত। যেদিক দিয়ে বিবেচনা করা হোক না কেন, সব উপাদান দেখা যায় স্যমন্তকে। অনাত্মীয়ও কীভাবে মহা-আত্মীয় হয়ে যায় তার একটি চমৎকার দলিল স্যমন্তক। 
স্যমন্তক উপন্যাসের বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপ আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। প্রতিটি লাইনই মুখস্থ করে রাখার মতো। ভালোবাসা- দ্রোহ, স্নেহ-প্রেম, স্বার্থিক দ্বন্দ্ব, মায়া-মমতা-অভিমান, আর্থ-সামাজিক অবস্থা, পিতাপুত্র-পরিবার, ধর্ম, রাজনীতি, ইতিহাস, নগরজীবন, গ্রামীণজীবন, মূল্যবোধ, শিক্ষাব্যবস্থা, যোগাযোগ, প্রশাসন, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ, বিশ্বপ্রকৃতি এমনকি বস্তি হতে শুরু করে মনুষ্য জীবনের সঙ্গে জড়িত সবকটি বিষয় নিখুঁত মাধুর্যে বিধৃত হয়েছে। স্যমন্তক অনবদ্য এক উপন্যাস।
উপন্যাসের চরিত্রসমূহ অধিকাংশ পাঠকের কাছে পরিচিত। তাই লেখককে খুব সাবধানে লিখতে হয়েছে প্রতিটি সংলাপ। ঋদ্ধ সংলাপের সঙ্গে পরিশীলিত রসবোধ, উত্তম উদ্দেশ্য, ভাবনার প্রসারতা ও মানবতার স্ফূরণ উপন্যসটিকে অনবদ্য করে তুলেছে। জীবন থেকে নেওয়া ঘটনায় বিন্যস্ত এমন হৃদয়গ্রাহী পরিপূর্ণ উপন্যাস ইতোঃপূর্বে আমি পড়িনি। উদ্দেশ্য, কাহিনি, চরিত্র, বিষয়-বর্ণন, বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপ, কাব্যিকতা, পরিশুদ্ধ জীবনবোধ, স্পর্শকাতর সম্পর্ক ও পরিণতি বিবেচনায় বাংলা সাহিত্যে এমন আর কোনো উপন্যাস আছে বলে আমার জানা নেই। এটি হতে পারে বাংলা সাহিত্যের একটি শ্রেষ্ঠ উপন্যাস।

Tuesday 17 January 2017

স্যমন্তক : মানবতার নিটোল শিহরণ / অধ্যাপক দীপক কুমার নাগ


স্যামন্তক

মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য- এ দার্শনিক কথাটির সত্যতা কি আপনি খুঁজতে চান? এজন্য আপনাকে হিমালয় অথবা কোনো পর্বতমালার পাদদেশে যেতে হবে না। আপনি এক কপি স্যমন্তক সংগ্রহ করে নিন। 
প্রথমত মনে হতে পারে, এ বুঝি লেখক তাঁর কল্পনার ফানুসে মনের আবেগ ও মাধুরী মিশ্রিত করে পাঠকদের জন্য একখানা গল্প বানিয়েছেন। যে কাজটি কবি-সাহিত্যিকগণ সাধারণত করে থাকেন। না, তা নয়। স্যমন্তক বাস্তব ঘটনার তিল তিল মাধুরী দিয়ে সৃষ্ট একটি উপন্যাস- যার লাইনে লাইনে রয়েছে জীবনাভিজ্ঞতার উন্মেষে লালিত মানবতাবোধের নিটোল শিহরণ।
স্যমন্তকের নায়িকা চরিত্রে যিনি রয়েছেন (জানি না সে কে?)। নায়ক (যিনি লেখক) আমার দৃষ্টিতে একজন মানুষ। দেবত বলব না, কারণ দেবতাদের মাঝেও যে স্বার্থপরতা রয়েছে! কেননা, দেবতাও তার ঘরে আশ্রয় নেয়, যে ঘরে ফুলচন্দন বেশি পড়ে। 
এদিক থেকে স্যমন্তকের নায়ক (লেখক) একজন মানুষের দর্শন নিয়ে যে কাজটি জীবনে করেছেন- সেই একটি কাজের জন্যই আমি তার জীবনকে নিঃসংশয়ে ধন্য হয়ে গিয়েছে বলতে পারি। তার আর কোনো কাজ না-করলেও চলবে। 
স্যমন্তকের প্রেরণ প্রেরিত হোক জনে জনে। স্যমন্তক ধন্য করুক মানুষের মনুষ্যত্ব, জয় হোক মানবতার!

Saturday 14 January 2017

স্যমন্তক / ড. সাহিদা সুলতানা অনি

 স্যমন্তক কেন পড়বেন

ড. মোহাম্মদ আমীনের লেখা স্যমন্তক উপন্যাসের কাহিনি পৌরাণিক স্যমন্তকের কাহিনির চেয়েও আকর্ষণীয়, হৃদয়গ্রাহী ও মুগ্ধকর। বাস্তবতা আর জীবনের উত্তম বিষয় থেকে তিল তিল উত্তম বিষয়সমূহ নিয়ে এ তিলোত্তম উপন্যাসটি রচিত। পৌরাণিক স্যমন্তক ছিল মহামূল্যবান মণি। যে মণির স্পর্শে স্বর্ণে পরিণত করা যেত সাধারণ কিছু বস্তুকে। তবে পরশ পাথরের সঙ্গে স্যমন্তকের তফাৎ আছে। যে কেউ পরশ পাথর অধিকারে রাখতে পারতেন এবং এর স্পর্শে যে কোনো কিছুকে স্বর্ণে পরিণত করা যেত। তবে স্যমন্তক এমন একটি মণি, যা অধিকারে রাখতে হলে তার কিছু গুণ থাকা আবশ্যক ছিল। শুধু তাই নয়, কোনো বস্তুকে স্যমন্তকের স্পর্শে স্বর্ণে পরিণত করতে হলে ওই বস্তুটিরও কিছু যোগ্যতা থাকতে হতো। 
পৌরাণিক স্যমন্তক একটি মহামূল্যবান মণি। আমাদের স্যমন্তক মণি নয়, মহামূল্যবান একজন মানুষ।উপন্যাসের নায়ক। যার পরশে অতি সাধারণ মানুষও পরিণত হয়েছে মূল্যবান মানুষে। পৌরাণিক স্যমন্তক ছিল সূর্যদেবের কণ্ঠহারের রত্ন | বিষ্ণু পুরাণ এবং মহাভারত অনুযায়ী এই রত্ন সোনার চেয়ে ৮ গুণ বেশি উজ্জ্বল ছিল | পৌরাণিক স্যমন্তকের আকর্ষণ ছিল উজ্জ্বলতা।আমাদের স্যমন্তকের আকর্ষণ ভালোবাসা।যা স্বর্ণের চেয়ে কোটি গুণ অধিক উজ্জ্বল। ভালোবাসা মানুষকে স্যমন্তকে পরিণত করতে পারে। কীভাবে একজন সাধারণ মানুষ স্যমন্তকের মতো মহামূল্যবান হয়ে উঠতে পারে এবং কীভাবে অন্যকেও অমন মূল্যবান করে তুলতে পারে - তা জানার জন্য উপন্যাসটি একবার হলেও পড়া প্রয়োজন।

স্যমন্তক মণি ছিল সূর্যদেবের কণ্ঠহারের রত্ন | বিষ্ণু পুরাণ এবং মহাভারত অনুযায়ী এই রত্ন সোনার চেয়ে ৮ গুণ
বেশি উজ্জ্বল ছিল | সূর্যদেব খুশি হয়ে স্যমন্তক মণি উপহার দেন তাঁর পরম ভক্ত দ্বারকার সত্রাজিৎকে | কৃষ্ণ তাঁকে অনুরোধ করেন ওই মণি রাজা উগ্রসেনকে দিয়ে দেওয়ার জন্য | কিন্তু তাঁর কথা উপেক্ষা করেন সত্রাজিৎ | তিনি ওই রত্ন দেন তাঁর ভাই প্রসেনকে | 

একদিন প্রসেন ওটি কণ্ঠহারে পরে গেলেন শিকারে | গাছে বসে এক সিংহকে তাক করেছেন তিনি | গলায় ঝুলছে দুর্লভ মণি | হঠাৎ হিসহিস শব্দ শুনে উপরে তাকান প্রসেন | চমকে দেখেন‚ মাথার উপরে দুলছে বিষাক্ত সাপ |উপরে সাপ‚ নিচে সিংহ‚ কী করবেন বুঝতে না পেরে লাফ দিলেন প্রসেন | যে কণ্ঠহারে ছিল স্যমন্তক‚ সেটি গাছের ডালে জড়িয়ে গলায় ফাঁস লেগে মৃত্যু হল প্রসেনের | জমিতে ছিটকে পড়ল স্যমন্তক | 

উজ্জ্বলতা দেখে সিংহ সেটিকে নিয়ে গেল মুখে করে | কিন্তু পথে এসে পড়ল ভাল্লুকরাজ জাম্বুবান | তিনি সিংহকে মেরে হস্তগত করলেন মণি |এদিকে প্রসেনকে না পেয়ে সত্রাজিৎ হাজির কৃষ্ণের কাছে | তিনি সরাসরি দোষারোপ করলেন‚ মণির লোভে প্রসেনকে হত্যা করেছেন কৃষ্ণ নিজে | অতঃপর অপরাধ খণ্ডাতে কৃষ্ণ নিজে গেলেন প্রসেনের সন্ধানে |
গভীর বনে গিয়ে কৃষ্ণ দেখতে পেলেন প্রসেনের নিথর দেহ | কিন্তু উধাও স্যমন্তক | কৃষ্ণ জমিতে সিংহের পদচিহ্ন অনুসরণ করে এগোলেন | দেখলেন পড়ে আছে পশুরাজের দেহ | বুঝলেন তার সঙ্গে অন্য কোনও পশুর ধস্তাধস্তি হয়েছে |
এবার নতুন করে বনভূমির রেখা অনুসরণ করে এগোলেন কৃষ্ণ | গিয়ে পৌঁছলেন জাম্বুবানের গুহামুখে | গুহামুখে বেরিয়ে আসা উজ্জ্বল ছটা দেখে বুঝলেন গুহার ভিতরেই আছে স্যমন্তক | সঙ্গীদের বাইরে রেখে একাই প্রবেশ করলেন কৃষ্ণ | দেখলেন‚ রত্ন নিয়ে খেলছে জাম্বুবানের পুত্র ! 

সেই মুহূর্তে কৃষ্ণের সামনে এলেন জাম্বুবান | দুজনের ভিতর যুদ্ধ হল টানা ২৮ দিন ধরে | অবশেষে আত্মসমর্পণ করলেন ভাল্লুকরাজ | কৃষ্ণের হাতে ফিরিয়ে দিলেন স্যমন্তক | সেইসঙ্গে নিজের মেয়ে জাম্ববতীকে | বিবাহ সম্পন্ন হল কৃষ্ণ-জাম্ববতীর |মণি এবং নববধূকে নিয়ে দ্বারকায় ফিরলেন কৃষ্ণ | ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমা চাইলেন সত্রাজিৎ | অনুতপ্ত হয়ে কৃষ্ণকে দিতে চাইলেন স্যমন্তক মণিসহ নিজের তিন মেয়ে সত্যভামা‚ ব্রতীনি এবং প্রস্ববিনীকে |  

সত্রাজিৎ কন্যাদের পানি গ্রহণ করলেন শ্রীকৃষ্ণ | কিন্তু নিলেন না স্যমন্তক | সেটি রয়ে গেল সত্রাজিতের কাছেই |এদিক সত্যভামার প্রতি অনুরক্ত ছিলেন দ্বারকার শতধন্ব‚ অক্রূর এবং কৃতবর্মা | তাঁরা সত্রাজিতের এই আচরণ মেনে নিতে পারেননি | একদিন‚ কৃষ্ণ-বলরাম গেছেন হস্তিনাপুরে | ঘুমন্ত সত্রাজিতকে হত্যা করে স্যমন্তক মণি চুরি করলেন শতধন্ব | পরে আতঙ্কিত হয়ে ওই রত্ন অক্রূরের কাছে রেখে পালিয়ে যান তিনি | 

সব জানতে পেরে দ্বারকায় ফিরে আসেন কৃষ্ণ-বলরাম | দুজনে শতধন্বের সন্ধানে গেলেন | মিথিলার কাছে কৃষ্ণের হাতে প্রাণ হারালেন শতধন্ব | আরও একবার বার কৃষ্ণ স্যমন্তক মণি নিয়ে ফিরলেন দ্বারকায় | তিনি এ বার স্যমন্তক মণি দিয়ে দিলেন অক্রূরকে | একটা শর্তে‚ যেন এই মণি কোনওদিন দ্বারকার বাইরে না যায় | এইভাবে স্যমন্তক ফিরে এল দ্বারকায় | একইসঙ্গে কৃষ্ণ চারজন দার পরিগ্রহ করলেন | 

কৃষ্ণের প্রয়াণ বা দ্বারকার পতনের পরে এই মণির কী হয়েছিল তা বলা হয়নি মহাকাব্য বা পুরাণে | অনেকে মনে করেন ‚ কোহিনূর হিরেই হল পুরাণের স্যমন্তক | যদিও এই মত অগ্রাহ্য করেন বেশিরভাগ পণ্ডিত এবং রত্ন বিশেষজ্ঞ | তাঁরা মনে করেন এই রত্ন ছিল আসলে একটি দুর্লভ চুনী ।

স্যামন্তক / ড. হায়াৎ মামুদ

‘স্যমন্তক’ 
স্যমন্তক’ ড. মোহাম্মদ আমীনের লেখা একটি উপন্যাস।একজন বললেন, এটি মনস্তাত্বিক উপন্যাস। পাণ্ডুলিপি পড়ে আমার মনে হয়েছে, এটি শুধু মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস নয়।
ভালোবাসা, স্নেহ-প্রেম, দ্রোহ-অভিমান, রাষ্ট্র, রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি, বিশ্ব, প্রকৃতি-পরিবেশ প্রভৃতি হতে শুরু করে মনুষ্য জীবনের সঙ্গে জড়িত সবকটি বিষয় নিখুঁত মাধুর্যে বিধৃত হয়েছে। সমাজের হতদরিদ্র হতে শুরু করে প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত - এ উপন্যাসের চরিত্রের অন্তর্গত। ঋদ্ধ সংলাপের সঙ্গে পরিশীলিত রসবোধ উপন্যসটিকে অনবদ্য করে তুলেছে। জীবন থেকে নেওয়া ঘটনায় বিন্যস্ত এমন হৃদয়গ্রাহী উপন্যাস ইতোঃপূর্বে আমি পড়িনি।
বিষয়, বর্ণনা, পরিশুদ্ধি, প্রেম, মমতা, চরিত্র, সংলাপ ও কাহিনি বিন্যাস বিবেচনায় বাংলা সাহিত্যে এমন আর কোনো উপন্যাস আছে বলে আমার জানা নেই।